ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শহীদ ছাত্রনেতা নজির আহমদ, হয়েছিলেন সাম্প্রদায়িকতার বলি

১৯৪৩ সালের জানুয়ারির শেষদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের একটি সাংস্কৃতিক  অনুষ্ঠানে হিন্দুত্ববাদী বন্দনা ''বন্দে মাতরম'' গাওয়া এবং পূজার্চনাকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ও অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ ঘটনার ফলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ও মুসলমান শিক্ষার্থীরা মোটাদাগে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

| সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় প্রাণ হারান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শহীদ নজির আহমেদ

এর কিছুদিন পর ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন—বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের পুরাতন ভবনে যথারীতি ক্লাস চলছিল

পূর্বের ঘটনার জের ধরে ক্লাস চলাকালীন হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে শুরু হয় তীব্র উত্তেজনা। পরবর্তীতে সহিংসতায় রূপ নেয়।

লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে একদল আরেক দলের ওপর চড়াও হয়। দাওয়া-পাল্টা দাওয়া ও ব্যাপক হামলা করে দু'পক্ষই।বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে দুই দল তখন সম্মুখ সংঘর্ষে আবির্ভূত হয়। দুই দলেরই বেশ কিছু ছাত্র আহত হয়। সংঘর্ষ চলাকালীন সেসময় মুসলিম ছাত্রনেতা নজির আহমদ প্রতিপক্ষের হামলা ও ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন।

সহপাঠীরা ততক্ষণাৎ তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করে এবং  বিরতিহীন রক্তক্ষরণের ফলে কিছুক্ষণ পর মাগরিবের সময় তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

এমএ অধ্যয়নকালে নজির আহমদ অকালে প্রাণ হারান। ছবিসূত্র: দ্য ডেইলি স্টার বাংলা

তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক কবি জসীম উদ্দীন সারাদিন তার শয্যাপাশে ছিলেন। একজন শিক্ষক হিসেবে ছাত্রের প্রতি এমন নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্যনিষ্ঠ আচরণ বর্তমানে স্বপ্নের মতো মনে হয়। প্রথমবারের মতো বাংলার কোনো শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক কারণে শিক্ষার্থী নিহত হলেন। অমর হয়ে রইলেন শহীদ নজির আহমদ।

নজির আহমদের মর্মান্তিক মৃত্যুর ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ও ছাত্রদের মধ্যে বিভেদ আরও বাড়লো, পরিস্থিতি হলো আরও উত্তপ্ত।

উক্ত ঘটনায় দৈনিক যুগান্তরে ৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত একটি কলাম

নজির আহমদ ছিলেন স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের নেতৃস্থানীয় ছাত্র। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনদের পাক্ষিক 'পাকিস্তান' পত্রিকার ম্যানেজার ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পর 'পাকিস্তান' পত্রিকা আর প্রকাশ হয়নি। মুসলিম ছাত্রদের কাছে তিনি হয়ে গেলেন মহানায়ক—আদর্শ অর্জনে ত্যাগের প্রতীক, অবিভক্ত পাকিস্তানে ছাত্র রাজনীতির প্রথম শহীদ। সে কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্ররা '২ ফেব্রুয়ারি' শহীদ নজির আহমদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং ১৯৪৩ থেকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে দিনটি উদযাপন করা শুরু করে।

তৎকালীন ঢাবি ছাত্র রবীন্দ্রনাথ গুহ তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ''এরপর কয়েক বছর মুসলিম বন্ধুরা শহীদ নজিরের স্মরণে সভা করেছে। প্রতি বছরই একমাত্র হিন্দু বক্তা ছিলাম আমি। তার জন্য‌ও হিন্দু বন্ধুদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছে।''

রবীন্দ্রনাথ গুহের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট হয়, তখনকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা কতটা প্রবল ছিল। একজন সহপাঠীর স্মরণসভায় যোগ দেওয়ার মতো স্বাভাবিক মানবিক কাজকেও ধর্মীয় পরিচয়ের প্রশ্নে বিচার করা হত। এটি শুধু সেই সময়ের শিক্ষার্থীদের মনের অবস্থা নয়, বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিফলনও ছিল।

ব্রিটিশ ভারতের সেই সময়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছিল, যা একদিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গতি নির্ধারণ করছিল, অন্যদিকে পারস্পরিক সন্দেহ ও শত্রুতার পরিবেশ তৈরি করছিল। শিক্ষিত তরুণদের মধ্যেও এই বিভক্তি ছড়িয়ে পড়েছিল, যা ভবিষ্যতে বৃহত্তর সামাজিক সংঘাতের দিকে নিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ গুহের মতো একজন চিন্তাবিদের এ ধরনের অভিজ্ঞতা সেই সময়ের মনস্তত্ত্ব বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৪৪ সালে সৈয়দ আলী আহসানের সম্পাদনায় 'নজীর আহমদ' নামে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। উক্ত স্মারকগ্রন্থে আলী আহসানের তিনটি, সাজ্জাদ হোসায়েনের একটি, বেনজীর আহমদের একটি এবং অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের একটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়।

শহীদ নজিরের অন্তিমকালে তার শিয়রে থাকা পল্লি কবি জসীম উদ্দীনও একটি কবিতা লিখেছিলেন। সৌভাগ্যবশত সৈয়দ আলী আহসানের আত্মজীবনীতে এই তথ্যগুলো পাওয়া গেলেও দুর্ভাগ্যবশত উক্ত স্মারকগ্রন্থটি হারিয়ে গেছে কালের গহব্বরে।

শহীদ নজিরের আত্মত্যাগকে স্মরণীয় করে রাখতে তার বন্ধুরা একটি লাইব্রেরিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পুরান ঢাকার চকবাজারের উত্তর-পশ্চিম কোণে নাজিরা বাজারে একটি বিশাল আকারের পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই লাইব্রেরিকে কেন্দ্র করে মুসলিম ছাত্ররা পাকিস্তান সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা করতেন।

ভাষাসৈনিক আবদুল গফুর এ বিষয়ে বলেন, '১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭—এ দু'বছরের কলেজ জীবনে এসব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সাহিত্য-সংস্কৃতিক অঙ্গনেও নিয়মিত অংশ নিয়েছি। এই উপলক্ষেই নাজিরা বাজারে শহীদ নজির লাইব্রেরিতে যেতাম পাকিস্তান আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক পুস্তক-পুস্তিকা ও সংবাদপত্র পাঠ ও আলোচনা সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে।'

উল্লেখ্য, শহীদ নজির ফেনীর আলিপুর গ্রামের একটি দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু সেই সময়েও দারিদ্র্যকে জয় করে তিনি পড়াশোনা করেন।

তিনি ১৯৩৭ সালে মাধ্যমিক পাস করার পর ১৯৩৯ সালে ফেনী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হন। তিনি ১৯৪২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে সম্মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এমএ অধ্যয়নকালে তিনি শহাদাত বরণ করেন।

বলা যায়, শহীদ নজির আহমদ মুসলিম ছাত্রদের কাছে রাজনৈতিক আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে বিরাজমান ছিলেন। ঐতিহাসিক তথ্য উপাত্ত থেকে জানা যায়, তাকে কেন্দ্র করেই মূলত আবর্তিত হতো মুসলমান ছাত্রদের রাজনৈতিক কার্যক্রম। 

'বন্দে মাতরম' নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু-মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে যে রাজনীতির সূচনা হয়েছিল তিরিশের দশকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তা চল্লিশের দশকে আমদানি হয়। ছাত্র রাজনীতিতে উত্থানের সাথে সাথেই সহপাঠীদের হাতেই নিহত হলেন নজির আহমদ।

ভারতীয় উপমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের আগের এবং পরের পরিবেশে রয়েছে বিস্তর ফারাক। যেখানে তিরিশের দশকে ছাত্রদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান বলে তেমন কোনো বিভেদ ছিল না, সেখানে চল্লিশের দশকে ছাত্রদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান‌ই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান পরিচয় ও বাধা।

কেবল হিন্দু-মুসলমানই নয়, বরং যেকোনো রাজনৈতিক পরিচয় যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় আধিপত্য বিস্তার লাভ করে এবং সহিংস হয়ে উঠে, তখনই পরিস্থিতি এমন প্রাণনাশী হয়ে উঠে।

রাজনীতিতে প্রবেশের একেবারে সূচনাতেই নজির আহমদ জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির সুফলের চেয়ে কুফল‌ই প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে বেশি। পড়াশোনার জায়গা দখল করে মিছিল-মিটিং, নোটের জায়গা দখল করে লিফলেট, রেজাল্টের প্রতিযোগিতার বদলে প্রতিযোগিতা হয় পদের, পদলেহনের। এভাবেই একটি বিশ্ববিদ্যালয় তার মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হাঁটতে থাকে, যখন সে নুয়ে পড়ে রাজনৈতিক আধিপত্যের চাপে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির প্রথম শহীদ নজির আহমদের আত্মত্যাগের পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে। তিনি জীবন দিলেন, কিন্তু আমরা শিক্ষা নিলাম না—বরং উল্টো পথে হাঁটলাম। এই হাঁটার পরিণতি কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি আমরা। শহীদ নজির আহমদকে স্মরণ করে শিক্ষা নিতে হবে, যেন তার উত্তরসূরির পথ আর লম্বা না হয়। 

ছবি ও তথ্যসূত্র:

১. এ. কে. নাজমুল করিম স্মারকগ্রন্থ: অধ্যাপক মুহাম্মদ আফসার উদ্‌দীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০০

২. East Pakistan District Gazetteers Dacca: S. N. H. Rizvi, East Pakistan Govt Press, 1969

৩. জীবনের শিলান্যাস: সৈয়দ আলী আহসান, বাড কম্প্রিন্ট এন্ড পাবলিকেশন্স, ২০১৮

৪. বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন: সাঈদ-উর রহমান, অনন্যা প্রকাশনী, ২০০০

Next Post Previous Post
📢 আপনার ব্র্যান্ড/প্রতিষ্ঠানের কথা জানুক হাজারো অনলাইন পাঠক আজই বিজ্ঞাপন দিন 🛍️