সিলেটের রহস্যময় নূরুদ্দিন পরিবারের করুন কাহিনী

সিলেট শহরের একটি অভিজাত এলাকা, কোলাহল আর আভিজাত্যকে পাশ কাটিয়ে একটি নিস্তব্ধ বাড়ি, তালাবদ্ধ ফটকের পাশে শুধুই এক ভয়ঙ্কর নিরবতা। একটা সময় এই বাড়িতেই ছিল এক সুখী পরিবার, নুরুদ্দিন, তার স্ত্রী রুকেয়া বেগম, আর দুই মেয়ে সাফিয়া এবং আফিয়া। 

. সিলেটের রহস্যময় এক পরিবার ছিল নূরুদ্দিনের

এক ছাদের নিচে তাদের হাসি, আনন্দ ও স্বপ্ন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তারপর হঠাৎ করে এই সবকিছু একদিন বদলে গেল। বন্ধ হলো একে একে ঘরের সব দরজা, জানালা এবং পাড়া-প্রতিবেশীসহ আত্মীয়-স্বজনের সাথে যোগাযোগও। বন্ধ হলো হাসির আওয়াজ, বন্ধ হলো আলো, বন্ধ হলো জীবন। প্রতিবেশীরা কেবল দেখতে পেলো একটি পরিবার ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে অন্ধকারের অতল গহ্বরে।

দেড় বছর বন্ধ থাকার পর সেই বাড়ির দরজা যখন শেষ বারের মতো ভাঙ্গা হলো, তখন যা সামনে এলো তা শুধু অকল্পনীয়ই নয়, উদ্বেগ ও আতঙ্কেরও বটে। 

এবার চলুন প্রবেশ করি এই হাউজ অফ হররের রহস্যের গভীরে।

সিলেটের সুবিদ বাজারস্থ হাউজিং স্টেট এলাকাকে বলা চলে শহরের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা। নব্বইয়ের দশকে এখানেই ছিল এক জনপ্রিয় দর্জির দোকান। দোকানটি পরিচালনা করতেন রুকেয়া বেগম আর তাকে সাহায্য করতো তার দুই মেয়ে সাফিয়া ও আফিয়া। বিশেষ করে এলাকার নারীদের কাছে এটি ছিল প্রিয় স্থান। সবাই চিনতো পরিবারটিকে নূরুদ্দিন পরিবার নামে। কেননা পরিবারটির প্রধান কর্তা নূরুদ্দিন সাহেব ছিলেন এলাকার একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তবে প্রায় বিশ বছর আগে তিনি পাড়ি জমান লন্ডনে। রেখে যান তার সাজানো গোছানো সংসার।

নূরুদ্দিনের বড় মেয়ে সাফিয়া তখন সিলেট সরকারী মহিলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। আরেক মেয়ে আফিয়া আম্বরখানা গার্ল্স স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। নিজেদের পড়াশোনার পাশাপাশি মায়ের সাথে টেলার্সে হাতের কাজেও দক্ষ্য হয়ে উঠেছিল দুজনে। সামনে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ ছিল তাদের। তবে সবকিছুই কিছুদিন পর এলোমেলো হয়ে যায় এক রহস্যের মায়াজালে।

সাল তখন ১৯৯৮, লন্ডনের ঝলমলে জীবন পেছনে ফেলে প্রায় সাতাশ বছর পর দেশে ফেরেন নূরুদ্দিন। কিন্তু তার এই ফেরাটাই যেনো এক অদ্ভুত দূর্যোগের সূত্রপাত। পরিবারের মানুষগুলো বুঝ্তে পারলো নূরুদ্দিন আর আগের সেই মানুষটি নেই। বিদেশ থেকে ফেরার পরে এক অন্য রকম নূরুদ্দিনকে আবিষ্কার করে পরিবারটি। সবারই নজরে আসে তার মানসিক অবস্থার লক্ষণীয় পরিবর্তন। একসময় বাডির দেয়ালে আরবি এবং ইংরেজিতে বিভিন্ন অর্থহীন লিখা লিখতে শুরু করেন তিনি। তার ভাইয়েরা এইসবের প্রতিবাদ জানালে তিনি তাদের দিকে ধারালো অস্ত্র নিয়ে তেড়ে আসতেন।

একসময় মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন নূরুদ্দিন। ধীরে ধীরে একসময় সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে নূরুদ্দিন পরিবার। তবে এটি চূড়ান্ত রুপ লাভ করে একটি করুন মৃত্যুর মাধ্যমে। 

সাল ২০০৯ হঠাৎই মারা যান নূরুদ্দিনের স্ত্রী রুকেয়া বেগম। মৃত্যুর খবরে স্বাভাবিকভাবেই ছুটে আসেন স্বজনেরা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আগত স্বজনদের লাঠি দিয়ে আঘাত করে তাড়িয়ে দেন নূরুদ্দিন। এরপরে একাই নিজে নিজে দাফন করেন স্ত্রীর মরদেহ। তার একগুয়েমীর কারনে আত্মীয়-স্বজনেরা অংশ নিতে পারেননি রুকেয়া বেগমের দাফনে। বাসার দেয়ালের অপর পাশ থেকে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছেন সবাই নূরুদ্দিনের যতসব অদ্ভুদ কার্যকলাপ। 

বিনা চিকিৎসায় অনাহারে, অর্ধাহারে উনার স্ত্রীর সেখানেই মারা গিয়েছেন এবং মারা যাওয়ার পরে তিনি সেই লাশের পাশে কাউকেই যেতে দেননি। উনি নিজেই উনার স্ত্রীর গোসল করানোর থেকে শুরু করে সব কাজগুলোই করেছেন। তার পরে বন্ধ হয়ে যায় পরিবারটির সদর দরজা। 

এদিকে পুরোপুরিভাবে বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় সাফিয়া ও আফিয়ার। একসময় সেই দরজা আর খুলেনি। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে পরিবারটি যেনো অদৃশ্য হয়ে গেল। এমনকি বাসার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইনও বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন নূরুদ্দিন। কোনো আত্মীয়-স্বজন এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীদেরকেও বাড়ির সীমানায় ভীড়তে দিতেন না। দুই বোন সাফিয়া ও আফিয়াকে রাখা হতো আলাদা দুটি রুমে। এইসব রুমে প্রবেশাধিকার ছিলো শুধু তাদের পিতা নূরুদ্দিনের।

এভাবে কেটে যায় দেড় বছর। ২০১১ সালের ৩ জুলাই, প্রতিবেশীদের অনুরোধে পুলিশ এবং স্থানীয় ব্যক্তিবর্গরা সদর দরজা ভেঙে প্রবেশ করে নূরুদ্দিনের বাড়িতে। উদ্ধার করে নূরুদ্দিন ও তার দুই মেয়ে সাফিয়া ও আফিয়াকে। কিন্তু যে দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছিল উদ্ধারকারীরা তা ছিলো সত্যিকারার্থেই গা শিউরে ওঠার মতো ঘটনা। 

একতলা পাকা বাড়িটির ভেতরে ছোট বড় আটটি কক্ষ। এরমধ্যে মাত্র দুটি কক্ষ খোলা পাওয়া যায়। বাকি ছয়টি ছিল তালাবদ্ধ। যে দুটি কক্ষ খোলা ছিল সেগুলোতেও কালি-জলতে ভরা ও অপরিচ্ছন্ন। বাসায় বিদ্যুৎ, গ্যাস বা পানির সংযোগ নেই। ঘরের মেঝেতে কয়েকটি কুঁপি বাতি পরে থাকতে দেখা যায়। রান্নাবান্নারও কোনো ব্যবস্থাই চোখে পড়েনি।

বন্দীদশায় মেয়েদের নিয়মিত খেতে দিতেন না নূরুদ্দিন। এই সময় উপস্থিত সাংবাদিকেরা নূরুদ্দিনের সাথে এই অস্বাভাবিক জীবন-যাপন নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি ইংরেজিতে কিছু অসংলগ্ন কথা-বার্তা বলেন। 

এক পর্যায়ে ইংরেজিতে বলেন মাদার সব জানেন। মাদার বলতে তিনি বোঝান ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে। কেবল নূরুদ্দিনই নন, অসংলগ্ন কথা বলতে থাকে সাফিয়া-আফিয়াও। 

"কেন সবসময় ভেতরে থাকো?" বড় মেয়ে সাফিয়াকে এমন প্রশ্ন করলে সে বলে,

- "আমাকে এখানে আটকিয়ে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে, আমার সঙ্গে প্লেন আছে।" এরকম অনেক অসংলগ্ন কথা বলতে দেখা যায় তাকে।

এদিকে খাবার এবং যত্নের অভাবে একেবারেই কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না ছোট মেয়ে আফিয়া।

জনৈক এক প্রতিবেশী বলেন, "মেধাবি দুই ছাত্রীর এই করুণ পরিনতি জল এনে দেয় অনেকের চোখে। আমরা যারা এখানে ফেমিলি আছি তাদেরকে অনেক চেষ্টা করেও সেখান থেকে বের করতে পারিনি। কিন্তু দেখা গেছে তাদের সাথে কিছু বলতে গেলে বা দেখা করতে গেলে নূরুদ্দিন ধারালো অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করে"।

সেই অন্ধকার কুঠুরি থেকে উদ্ধারের পর সিলেট এম.এ.জি ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তিকরা হয় তাদেরকে। কঙ্কালসার ও মারাত্মক অসুস্থাবস্থায় সেখানে মেডিসিন এবং সাইকিয়াটিক বিভাগের চিকিৎসকদের তত্তাবধানে চিকিৎসা করানো হয় তাদের। চিকিৎসকেরা জানান তারা তিন জনই সিজোফ্রেনিয়া নামক মানসিক রোগে আক্রান।

২০১১ সালের ১৬ জুলাই তারিখে বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোরের সংবাদের জানা যায়,  চিকিৎসায় অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠেছিলেন নূরুদ্দিন ও তার মেয়েরা। তবে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরা আর কখনোই হয়নি। এটি ছিল এই ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত সর্বশেষ সংবাদ। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পরিবারটির সদস্যদের মধ্যে সবার আগে মৃত্যুর কাছে হার মানে বড় মেয়ে সাফিয়া। পরবর্তীতে নূরুদ্দিন এবং আফিয়াও পরকালে পাড়ি জমায়।

এই ঘটনাসাথে ঢাকার মিরপুরের রীতা-মিতার কাহিনী কিংবা ময়মনসিংহের আদম পরিবারের কাহিনী খুবই অদ্ভুদভাবে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। রহস্যময় এই পরিনতি কি শুধুই মানসিক অসুস্থতা নাকি অজানা কোনো শক্তির খেলা? এই রহস্যের উত্তর হয়তো বা কেউ জানে না। বদ্ধ কপাটের আড়ালে রয়ে গেছে সেই অজানা রহস্য। মানুষের মনের গহীন অন্ধকার হয়তো সবচেয়ে ভয়ংকর অন্ধকার। আমরা যখন মানসিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা করি তখনই তৈরি হয় এমন অদ্ভুত ঘটনা।

নূরুদ্দিনের পরিবার, মিরপুরের রীতা-মিতা কিংবা ময়মনসিংহের আদম পরিবার প্রতিটি ঘটনাই আমাদের সমাজের বিকৃত প্রতিবিম্ব। এই ঘটনা আমাদের একটি বড় শিক্ষা দেয় মানসিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা করলে তার পরিনতি ভয়াবহ হতে পারে। ◾

তথ্যসূত্র: 

১. bdnews24 - https://shorturl.at/A2drI

২. bdnews24 - https://shorturl.at/6SkoA

৩. Channel S - https://shorturl.at/bHBpO

Next Post Previous Post
📢 আপনার ব্র্যান্ড/প্রতিষ্ঠানের কথা জানুক হাজারো অনলাইন পাঠক আজই বিজ্ঞাপন দিন 🛍️