মিরপুরের রিতা-মিতা - ভৌতিক বাড়ি নাকি একাকীত্বের কারাগার?

প্রায় দুই যুগেরও বেশী সময় আগে স্বাভাবিক চাকচিক্যকে পাশ কাটিয়ে মিরপুরের একটি বাড়ি জনসম্মুখে পরিচিতি পায় ভৌতিক বাড়ি হিসেবে। সে বাড়ির ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় উচ্চশিক্ষিত দুই বোন ডাক্তার আইনুন নাহার রিতা এবং প্রকৌশলী নুরুন্নাহার মিতাকে। দুই বোনই ছিলেন মেধাবী শিক্ষার্থী। আইনুন নাহার রিতা সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেন। আর মিতা বুয়েট থেকে ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বিদেশে গিয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নেন।

. মিরপুরের চিকিৎসক ও প্রকৌশলী দুই বোন রিতা-মিতা

তবে ধীরে ধীরে তাদের জীবন একটি অবরুদ্ধ অন্ধকারে রুপান্তরিত হতে লাগল। তারা পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের মিরপুরের পৈতৃক বাড়িতে নিজেদেরকে বন্দী করে ফেলেন। তবে এই ঘটনা শুধু একটি উদ্ধার কাহিনীই নয় বরং দেশের মানুষের কাছে একটি অস্পষ্ট এবং রহস্যময় গল্প হয়ে আছে আজো। 

মিরপুর ছয় নম্বর সেকশনের সি ব্লকের নয় নম্বর সড়কের ১ নম্বর বাড়ি তাদের। সড়ক ধরে হাঁটতে গেলে উঁচু প্রাচীর ঘেরা এই পুরনো বাড়িটি যেন নজর এড়িয়ে যেত। চারপাশে মাথা উচুঁ করে দাড়ানো অট্টালিকার ভীড়ে বাড়িটি ছিল খুবই বেমানান। স্থানীয় লোকজন এই বাড়িটির নাম দিয়েছিল ভুতের বাড়ি। 

. মিরপুরের রহস্যময় রিতা-মিতাদের বাড়িটি
এই অদ্ভুত নামের পেছনের কারণ বাড়িটির দরজা-জানালা বন্ধ থাকতো সব সময়ই। বাড়িতে বসবাস করা দুই বোন এবং তাদের মা কখনোই বাইরে বের হতেন না তাদের বাড়ি থেকে। কাউকে কখনো বাড়ির ভেতরে ঢুকতেও দেখা যেত না এই বাডিতে। কখনো কোনো উৎসবের আমেজে রঙিন হয়নি বাড়িটি। সবসময়ই অন্ধকারে ঢাকা বাড়িটির প্রধান ফটকের ভেতরে উকিঁ দিলে কেবল দেখা যেতো বাড়িটির সদস্যদের অস্বাভাবিক চলাফেরা এবং জীবনযাপন। 

রহস্যময় এই বাড়িটির প্রবেশ ফটকের পাশে দেয়ালে নাম ফলকে লিখা রয়েছে ডাক্তার আইনুন নাহার রিতা। বাবার মৃত্যু এবং বড় বোন কামরুন নাহার হেনার বিয়ের পর ডাক্তার রিতা তার ছোট বোন ইঞ্জিনিয়ার মিতাকে নিয়ে এই বাডিতে থাকতেন। সাথে থাকতেন তাদের বৃদ্ধা মা। একাকীত্ব থেকে তারা ধীরে ধীরে নিজেদেরকে গুটিয়ে নেন সমাজ এবং প্রতিবেশিদের কাছ থেকে।

তবে এই বাড়ি কিন্তু সবসময়ই এমন ছিল না। একটা সময়ে এই বাড়িতেই চেম্বার খুলে রুগি দেখতেন ডাক্তার আইনুন নাহার রিতা। তাদের বাড়িতে ছিল প্রাণের ছোঁয়া, ছিল হাসি- আনন্দও।

২০০৫ সালের ৭ই জুলাই মধ্যরাতে তাদের বাড়ির আশেপাশের প্রতিবেশীরা এক অদ্ভূত দৃশ্য দেখেন। হারিকেন জ্বালিয়ে বাড়িতে থাকা দুই বোন বাডির উঠনে একটি গর্ত খুড়ঁছেন, যা দেখতে অনেকটা কবরের মতোই। এই ঘটনা ব্যপক আলোচনার জন্ম দেয়। ঘটনাটি চারদিকে জানাজানি হলে এই পরিবারের সদস্যদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইট্স ফাউন্ডেশন।

বাডির ভেতরে গিয়ে একটি অদ্ভূত দৃশ্য দেখেন তারা। বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া তাদের বৃদ্ধা মায়ের কঙ্কালসার দেহ পড়ে আছে গরের ভেতরে। মায়ের মৃত্যুর খবর কাউকে না জানিয়ে কোন ধরনের ধর্মীয় রীতি-নীতি না মেনেই বাডির উঠোনে মাকে রাতের অন্ধকারে কবর দেয়ার চেষ্টা করছিলেন এই দুই বোন। 

বাড়ির সর্বত্র ছিল ময়লা আবর্জনা এবং মনুষ্য বর্জ্য ছড়ানো ছিটানো। রিতা-মিতাকে যখন মিরপুরের বাডি থেকে উদ্ধার করা হয় তখন তারা ছিলেন পুরোপুরি বিপর্যস্ত ও মানসিক ভারসাম্যহীন। মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত দুই বোনকে উদ্ধার করে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। দিনের পর দিন গৃহবন্দি অবস্থায় থেকে তাদের শরীর বিবর্ণ হয়ে গেছে। ফ্যাকাশে পুরো দেহ হয়ে পডেছে কঙ্কালসার। শরীর ছিল প্রচন্ড দুর্বল। 

রিতা এবং মিতার অগাধ বিশ্বাস ছিল সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। 

১৯৯৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এই দুই বোন তাদের বড় বোন হেনা এবং অন্যান লোকজনকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলেছেন। তারা ঘরের বাইরে বের হতেন না। কেবল মাসে কয়েকবার বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছু খাবার, মোমবাতি, দিয়াশলাই এই ধরনের জিনিস কিনে আবার বাড়িতে ঢুকে ফটক লাগিয়ে দিতেন। দীর্ঘদিন বিল না দেয়ায় একসময় তাদের ঘরের বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের লাইন কেটে দেয়া হয়েছিল। অন্ধকারে কেবল মোম জ্বালিয়ে এবং বাইরে থেকে খাবার এনে তাদের দিন কাটতে। তাদেরকে যখন উদ্ধার করা হয় তখন সে ঘর থেকে উদ্ধার করা হয় অনেক গুলো দুুধের কৌটা। তা থেকে ধারণা করা হয় তারা হয়তো সেগুলো পানির সঙ্গে গুলিয়ে খেয়ে এতো দিন বেঁচে ছিলেন।

উদ্ধারের পর তাদের চিকিৎসার দায়িত্বে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাইকিয়াট্রিক বিভাগ।

ইনস্টিটিউটের তখনকার চিকিৎসক ডাক্তার মুহিত কামালের অধীনে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠেন প্রকৌশলী ও চিকিৎসক দুই বোন।

. চিকিৎসাধীন চিকিৎসক ও প্রকৌশলী দুই বোন

সরকারের পক্ষ থেকে রিতাকে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে এবং মিতাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। এরপর কয়েক দিন ভালোভাবে এই কাজ করেন রিতা এবং মিতা। এই সময় তাদের বাড়িটি সংস্কার করতে দিয়ে তারা একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন দুই বোন। কিন্তু তাদের পিছু ছাড়েনি সেই পুরনো দিনগুলোর ছায়া। ২০১৩ সালে আবারও হঠাৎ হারিয়ে যায় এই দুই বোন। দুই মাস তাদের কোনোই সন্ধান যায় না কোথাও।

দীর্ঘ দুই মাস পর তাদের সন্ধান মেলে বগুড়ার একটি আবাসিক হোটেলে। আকবরীয়া হোটেল নামক এই হোটেলেই দুই মাস অবস্থান করছিলেন তারা। হোটেলের ব্যবস্থাপক লিটন রহমানের সূত্রে জানা যায় এই দুই মাস একটানা হোটেলের রুমেই কাটিয়েছিলেন তারা। কারো সঙ্গে কথা বল্তেন না, কারো সাহায্যও নিতেন না। মাঝে মধ্যে একজন বাইরে এসে খাবার দিয়ে যেতেন। হোটেলের ভাড়া ৭০ হাজার টাকাও তারা পরিশোধ করেছিলেন। কিন্তু শেষ এক সপ্তাহ হতে তারা হোটেলের ভাড়া পরিশোধ না করায় হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদের খোজ করে।

এই সময় তারা অসংলগ্ন এবং আধ্যাতিক কথা-বার্তা বলতে থাকেন। কয়েক দিন থেকে রুমের দরজা একটানা বন্ধ করে দিলে হোটেল কর্তৃপক্ষ পুলিশকে জানায়।

পুলিশ এসে অনেক ডাকাডাকির পরও তারা হোটেল কক্ষের দরজা খোলেন নি। তাদের অনুরোধ করে বলা হয় আপনারা কিছু খেতে বাইরে আসুন। তারা বলেন, হোটেলের সব শয়তান শব্দ শুনে জেগে যাবে। বাংলাদেশে শয়তানে ভরে গেছে। আল্লাহর হুকুম ছাড়া দরজা খোলা যাবে না। প্রায় পঁচিশ মিনিট পরে দরজা খুলে মিতা বলেন, "হুকুম হয়েছে আপনাদের সঙ্গে যাওয়ার। চলেন আমরা যাবো।"

সেখান থেকে উদ্ধারের পর বগুড়া শহরতলীর বারপুরে সামাজিক প্রতিবন্ধী পূনর্বাসন কেন্দ্রে নেয় হয় তাদের। 

এই সময় প্রকৌশলী মিতা কেন্দ্রের কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকের বলেন, তারা দুই বোন বাংলাদেশের মালিক। বাংলাদেশ দোজখ হয়েছে। আল্লাহর নির্দেশে তারা কানাডা থেকে বগুড়ায় এসেছেন। তারা এখনো যুদ্ধ করছেন। আল্লাহর নির্দেশ পেলেই তারা আবারো কানাডায় ফিরে যাবেন।

পরবর্তীতে বড় বোন কামরুন নাহার হেনার জিম্মায় দেয় হয় এই দুই বোনকে। সেখান থেকে তিনি বোনেদের নিয়ে এসে রিতা এবং মিতাদের মিরপুরের বাড়ি দেখাশোনা করছেন। এরপর তাদের বড় বোন কামরুন নাহার হেনা বাড়িটিতে একটি দোকান কোটা ভাড়া দিয়েছেন।

রিতা এবং মিতার বর্তমান জীবন এক ধরণের অন্ধকারে আবদ্ধ। এখনো তারা অপরিচিত কারোর সঙ্গে দেখা করেন না। তাদের মানসিক অবস্থা কিছুটা উন্নতি হলেও তারা স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরতে পারেন নি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রিতা এবং মিতার এই পরিস্থিতির মূলে রয়েছে সিজোফ্রেনিয়া নামক একটি মানসিক রোগ। এই রোগে আক্রান্তরা কল্পনার জগৎ তৈরি করে বাস্তবতার সাথে গুলিয়ে ফেলেন। যার মাঝে বাস্তবতার লেশ মাত্র কোন অস্তিত্ব নেই। বাস্তবতার সাথে তাদের চিন্তা, চেতনা, আবেগ, অনভূতি এবং বোধ শক্তির এতো বেশী ফারাকের জন্যই এটি কে সাইকোসিস (Psychosis) বলা হয় মেডিকেলের ভাষায়।

সাইকিয়াট্রিক রুগীরা নিজেরা যে অসুস্থ সেটি পর্যন্ত তারা বুঝতে পারেন না। এই রুগীরা গায়বী আওয়াজ শুনতে পান। তাদেরকে বিভিন্ন কাজে নির্দেশনা দেওয়া হয় এমনটিও তারা শুনতে পান। রিতা এবং মিতার কাহিনি আজও একটি রহস্যময় হয়েই রয়েছে। রয়েছে তাদের সেই বাড়িও। এই বাড়ির ইট কাঠের মাঝেই চাপা পডে আছে এক নৃশংসতার কাহিনী। যা সময়ের সাথে সাথে মানুষকে শেখায়, জীবন যতোই কঠিন হোক না কেনো একাকীত্বের পরিনতি কখনোই সুখকর হয় না। পরিশেষে একটি কথাই সত্য, পরিবারের মধুর বন্ধন মানসিক স্বাস্থ্যের মহৌষধ। ◾

তথ্যসূত্র:

১. ভূতের বাড়িতে সবই আছে, নেই শুধু রিতা-মিতা

২. রিতা-মিতা কি জীবিত আছেন? কেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেন না দুই বোন?

৩. ১৮ বছর পরও স্বেচ্ছা ঘরবন্দি সেই রিতা-মিতা

৪. সেই ভূতের বাড়িতে এখন ভূত নেই, চিকিৎসক-প্রকৌশলী দুই বোন সুস্থ

Next Post Previous Post
📢 আপনার ব্র্যান্ড/প্রতিষ্ঠানের কথা জানুক হাজারো অনলাইন পাঠক আজই বিজ্ঞাপন দিন 🛍️