স্লেজিং : ব্যাট-বলের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার মনস্তাত্ত্বিক এক কৌশল
ক্রিকেট একটি মনস্তাত্ত্বিক খেলা। অনেকে আবার বলেন ভদ্রলোকের খেলা। বোলার, ব্যাটার, ফিল্ডার সবাইকে নিবিড় মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি বল খেলতে হয়। একটু মনোযোগ নষ্ট হলেই সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। আর এই সুবিধা নিতেই জন্ম হয়েছে স্লেজিংয়ের। বিশেষ করে ভালো ব্যাটাররা যখন ধৈর্য সহকারে খেলতে থাকেন তখন তাদের মনোযোগে কিছু ঘটাতে বা রাগিয়ে দিয়ে ক্রিকেটে শুরু হয় স্লেজিং।
![]() |
| স্লেজিং নামের মনস্তাত্ত্বিক লড়াই এখন ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গেই পরিণত। |
স্লেজিংয়ের নানা কথা
প্রায়ই দেখা যায় ব্যাটাররা ফিল্ডারদের খোঁচা মারা কথা শুনে রেগে গিয়ে উল্টা পাল্টা শট খেলে আউট হন। আবার কখনো কখনো ব্যাটাররাও বোলারদের মনোযোগ নষ্ট করতে স্লেজিং করে থাকেন। এখনকার দিনে এটিকে খেলোয়াড়ি আচরণ হিসেবেই দেখা হয়, যে কারণে ক্রিকেটে স্লেজিং নিষিদ্ধ নয়। প্রতিপক্ষের ওপর চাপ বাড়াতে এর আশ্রয় নেন ক্রিকেটাররা।
ক্রিকেটে স্লেজিংয়ের জন্মটা অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে স্লেজিং শব্দটার সূচনা। অস্ট্রেলীয় সংবাদ মাধ্যম ক্রিকেট মাঠের এই খোঁচা মারা কথাগুলোকে স্লেজিং' নাম দেয়। জানা যায়, ১৯৬৪-৬৫ মৌসুমের শেফিল্ড শিশু লীগ চলাকালীন কথাটা প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল। তারপর এটি দ্রুত জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে ক্রিকেটারদের মাঝে। আজকাল তো ম্যাচের আগেই স্লেজিং শুরু হয়। মিডিয়ায় প্রতিপক্ষ দলকে উদ্দেশ্য করে নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে তাদের মনোবল নষ্ট করার চেষ্টা করেন অনেকে।
ক্রিকেটে স্লেজিং ভালো না কি মন্দ সেটি নিয়ে মত-দ্বিমত আছে। অনেকে মনে করেন, এটি খেলার অংশ। শক্ত মনোবলের খেলোয়াড়রা এসব সামলেই ম্যাচ জিততে পারেন। আবার অনেকে মনে করেন এভাবে প্রতিপক্ষকে রাগিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে খেলার ভাবমর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
স্লেজিংয়ে বরাবরই অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের কুখ্যাতি আছে। বিশেষ করে দেশটির মাটিতে খেলতে গেলে বিদেশি ক্রিকেটারদের তারা রীতিমতো তুলোধুন্যে করেন। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহর মতে, স্লেজিং হচ্ছে যুদ্ধের আগেই প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলা। ভারতের সাবেক অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনী স্লেজিংকে মনে করেন একটি শিল্প।
আবার সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক মাইক ব্রিয়ারণি মনে করেন, এটি ক্রিকেটীয় চেতনার পরিপন্থী। তাই আইসিসির উচিত স্লেজিং বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। তিনি বলেন, ক্রিকেট মাঠে আপনার সবাইকে সম্মান করতে হবে। আগ্রাসী মনোভাবের নামে খেলোয়াড়দের মধ্যে নাক সিটকানোর একটা ব্যাপার আছে। আমি ওই মনোভাব ঘৃণা করি।
তবে অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও আইসিসি স্লেজিং বন্ধে কোনো নিয়ম করেনি এখন পর্যন্ত।
একবার ১৯৮৩ সালে পাকিস্তান-ভারত টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচ চলছিল বেঙ্গালুরুতে। পাক-ভারত ম্যাচ মানেই উত্তেজনা। সেদিনও তার কমতি ছিল না। নিজেদের প্রথম ইনিংসে ২৭৫ রানে অলআউট হওয়া ভারতীয় বোনাররা চেষ্টায় ছিলেন পাকিস্তানকে অল্প রানে আটকে রাখতে। একশো রানের আগেই ৪ উইকেট তুলে নিয়ে সেই পথে অনেকটাই সফল ছিলেন তারা। কিন্তু এক প্রান্তে বাধা হয়ে দাঁড়ান জাভেদ মিয়াদাদ। খুব ধৈর্যের সাথে ব্যাট করছিলেন তিনি। ভারতীয় ফিল্ডাররা এটা-সেটা বলে মিয়াদাদকে ক্ষেপিয়ে তুলতে চেষ্টা করছিলেন। এক পর্যায়ে মিয়াদাদ বিরক্ত হয়ে বোলার দিলিপ দোশিকে ডেকে বলেন, 'তেরা রুম নাম্বার কেয়া হ্যায়? (তোমার রুম নম্বর কত?)
সেই ম্যাচে স্টেডিয়ামের কাছেই ছিল ক্রিকেটারদের হোটেল। দোশি অবাক হয়ে জানতে চান, কেন?
মিয়াদাদ বলেন, আমি ছক্কা মেরে তোমার রুমে বল পাঠাবো।
আসলে মিয়াদাদ সেদিন পাল্টা খোঁচা দিয়ে ভারতীয় এই স্পিনারের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটাতে চেয়েছিলেন। কারণ দোশি সেদিন খুব টাইট বোলিং করছিলেন। মিয়দাদের আশা ছিল, এই কথা শুনে তার মেজাজ গরম হয়ে উঠবে এবং বল করতে গিয়ে লাইন লেতু মিস করবেন। শেষ পর্যন্ত সেই ম্যাচে ৯৯ রান করে পাকিস্তানকে লিড এনে দিয়েছিলেন 'বড়ো মিয়া।
আরেকটি ঘটনার কথা বলি। শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার টেস্ট ম্যাচ চলছিল।
একপ্রান্ত আগলে ধরে ব্যাটিং করছিলেন নস্তান অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা। তার মনোযোগ নষ্ট করার জন্য অজি বোলাররা নানা কটু কথা বলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু রানাতুঙ্গা তার স্বভাবসুলভ ঠান্ডা মাথায় সামাল দিয়ে যাচ্ছিলেন সব চাপ। একটা পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে উইকেটরক্ষক ইয়ান হিলি রানাতুঙ্গাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বোলার প্লেন ম্যাকগ্রাকে বলেন, "ম্যাকগ্রা" উইকেটের ওপর একটা মারস চকোলেটের বার রেখে দাও। কাজে দেবে। শরীরটা দেখছ না কেমন!
ভারী স্বাস্থ্যের রানাতুঙ্গাকে চকোলেটের কথা বলে ক্ষেপিয়ে তুলতেই এই কথা বলেন তিনি।
আলোচিত কিছু স্লেজিং
২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট সিরিজের ঘটনা সেটি। সিরিজের শেষ ম্যাচে অজি ব্যাটার স্টিভ ওয়াহকে ব্যাটিংয়ের সময় স্লেজিং করেন ভারতীয় উইকেটরক্ষক পার্থিব প্যাটেল। ১৮ বছর বয়সি পার্থিব তখন স্টিড খয়াহকে বলেন, একটাও মিস না করে তুমি তোমার বিখ্যাত স্লগ সুইপ খেলতে পারো কিনা দেখি তো?
বয়সে অর্ধেক একজন ক্রিকেটারের স্লেজিং ইগোতে লেগেছিল ওয়াহরের। জবাবে তিনি পার্থিবকে বলেন, একটু তো সম্মান দেখাও। আমি যখন প্রথম টেস্ট খেলি তুমি তখন ন্যাপকিন পরতে।
এরপরের ঘটনাটা ভারতের সাবেক ক্রিকেটার রবি শাস্ত্রী এবং ইংলিশ ক্রিকেটার মাইক হুইটনির। সেই ম্যাচে হুইটনি মূল একাদশে ছিলেন না, বদলি ফিল্ডার হিসেবে মাঠে নেমে শাস্ত্রীকে স্লেজিং করতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে রবি শাস্ত্রী বললেন, ভালো ছেলের মতো ক্রিজে থাকো, নইলে মাথা ফাটিয়ে দেবো।
রবি শাস্ত্রীও কম যান না। মুখ বেঁকিয়ে জবাব দিলেন, তোমার মুখ যতটা চলে, ততটা ভালো বোলিং যদি করতে পারতে, তাহলে আর দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে ফিল্ডিং করতে হতো
স্লেজিং থেকে বিবাদ
কখনো কখনো স্লেজিং থেকে ক্রিকেট ম্যাচে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিরও জন্ম হয়। উভয় পক্ষই পরস্পরকে এমনভাবে কথা শোনাতে শুরু করেন, যা গিয়ে শেষ পর্যন্ত ঝগড়ায় রূপ নেয়।
২০০৭ সালে সিডনি টেস্টে অজি অলরাউন্ডার এন্ড্রু সাইমন্ডকে মাংকি (বানর) বলেছিলেন ভারতীয় স্পিনার হরভজন সিং। এটি নিয়ে তখন ক্রিকেট দুনিয়ায় অনেক হইচই হয়েছে। ম্যাচ রেফারি এই বর্ণবাদী গালির অভিযোগে হরভজনকে তিন টেস্টের জন্য সাসপেন্ড করেন। পরে বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আপত্তি তুললে বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয়। যদিও ঘটনার কোনো রেকর্ড না থাকায় বিষয়টি শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করা যায়নি। তারপর হরভজনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে ম্যাচ ফির পঞ্চাশ শতাংশ জরিমানা করা হয়। তবে বিষয়টি অনেক দূর গড়িয়েছিল, যা ক্রিকেট বিশ্বে বিতর্কিত ঘটনা হয়ে আছে।
স্লেজিং নিয়ে ঝগড়াঝাঁটির এমন আরো অনেক উদাহরণ আছে। ভারতীয় ব্যাটার সৌরভ গাঙ্গুলির সাথে পাকিস্তানি স্পিডস্টার শোয়েব আখতারের বেশ কয়েকবার ঝগড়া হয়েছে ম্যাচের মাঝখানে।
২০১৯ সালের মে মাসে রোহিত শর্মা আর ডেভিড ওয়ার্নারও ম্যাচের মাঝখানে এরকম ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন।
এমন উদাহরণ ক্রিকেটে বহু আছে। তারপরও স্লেজিং টিকে আছে। বেশির ভাগ ক্রিকেটারই স্লেজিংকে প্রতিপক্ষের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটানোর উপায় হিসেবে দেখেন। যদিও মাঝে মধ্যে কেউ কেউ স্লেজিং করতে গিয়ে মাত্রা ছাড়িয়ে যান। যেটি জন্ম দেয় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির। ◾