অপার মায়াবী এক সৌন্দর্যের প্রতীকের নাম হামহাম জলপ্রপাত

মানবমন সর্বদাই মুক্তি পিয়াসী, চিরচঞ্চল। একটু অবকাশ পেলেই মানুষ ছুটে যায় দিগ দিগন্তে সৌন্দর্যের আকর্ষণে। জন্মগতভাবেই মানুষ কৌতূহলী। তার সে কৌতূহল নতুন নতুন বিষয়ের প্রতি। প্রকৃতি ও মানুষের সৃষ্ট সৌন্দর্যের নানা নিদর্শন সে মানবীয় সন্তা দিয়ে অনুভব ও উপলব্ধি করতে চায়। তাহলে পরিচয় করিয়ে দেই এক আকর্ষণীয় পর্যটন নগরীর সাথে।

| অপার মায়াবী সৌন্দর্যের প্রতীকের নাম হামহাম জলপ্রপাত

যেখানে দীর্ঘ পথ জুড়ে সবুজ গালিচা বিছিয়ে আছে সারি সারি চা-বাগান। চা কন্যারা নিপুণ হাতে দুটি পাতা আর একটি কুঁড়ি সংগ্রহ করে ঝুলিতে ভরছেন। এরই মাঝে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মায়াবৃক্ষ। তাতে শিদ দিচ্ছে নানা রূপরঙের সুরেলা পাখি। পিচঢালা পথে চলতে চলতে স্বর্গীয় এক অনুভূতি ছুঁয়ে যায়। এমনই এক অপার মায়াবী সৌন্দর্যের প্রতীকের নাম হামহাম জলপ্রপাত।

অরণ্যঘেরা মায়াবী হামহাম জলপ্রপাতের কাচের মতো স্বচ্ছ পানি পাহাড়ের গা বেয়ে আছড়ে পড়ছে বড়ো বড়ো পাথরের গায়ে, গুঁড়ি-গুঁড়ি পানিকণা আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে তৈরি করছে কুয়াশার আভা।

| গুঁড়ি-গুঁড়ি পানিকণা আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে তৈরি করছে কুয়াশার আভা

বুনোপাহাড়ের প্রায় ১৯০ ফুট ওপর থেকে গড়িয়ে পড়া স্রোতধারা কলকল শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে পাথরের পর পাথর কেটে, সামনের দিকে তার গন্তব্যে। চারিপাশ গাছ গাছালি আর নাম না জানা হাজারো প্রজাতির লতাপাতা ও লতাগুলু আত্মাদিত হয়ে আছে পাহাড়ি শরীর। স্রোতধারা সে লতাগুল্মকে ভেদ করে গড়িয়ে পড়ছে ভূমিতে। তৈরি করছে স্রোতগিনী জনধারা। সে যে কি এক বুনোপরিবেশ না দেখলে বিশ্বাস করানো সম্ভব নয়। শ্রাবণের প্রবল বর্ষনে তখন পুরো জঙ্গল ফিরে পায় তার চিরসবুজ রূপ, হয়ে ওঠে সতেজ আর নবযৌবনা। হামহাম ঝরনা তখন ফিরে পায় অপরূপ সৌন্দর্য। ঝরনার সতেজতায় পাহাড়ি ঝিরিগুলো হয়ে উঠে কর্মচাল। সাঁই সাঁই করে যেয়ে চলে ঝিরির জলরাশি। স্বচ্ছ জলস্রোত যখন পা গলিয়ে চলে যায় নদীর দিকে সে জলের কোমল পরশে শরীর জুড়িয়ে যায় মুহর্তেই। 

| শ্রাবণের প্রবল বর্ষনে তখন পুরো জঙ্গল ফিরে পায় তার চিরসবুজ রূপ

হামহাম জলপ্রপাত সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দিরিজার্ভ ফরেস্টের কুরমা বনবিটের গহিন অরণ্যে অবস্থিত। কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত রাজকান্দি পাহাড়ের কুরমা বনবিট এলাকার আয়তন ৭ হাজার ৯৭০ একর। কুরমা বনবিট এলাকার পশ্চিম দিকে চাম্পারায় চা বাগান, পূর্ব-দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত। এই বনবিটের প্রায় ৮.৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে দৃষ্টিনন্দন এই হামহাম জলপ্রপাতটির অবস্থান। কমলগঞ্জ থেকে কুরমা চেকপোস্ট পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার পাকা রাস্তা। কুরমা চেকপোস্ট থেকে চাম্পারায় চা বাগান পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার মাটির রাস্তা। সেখান থেকে আবার প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে সীমান্ত এলাকায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বসতি কলাবনপাড়া। সেখান থেকেই শুরু দুর্গম জঙ্গল। সেই জঙ্গলের প্রায় ৮.৫ কিলোমিটার ভেতরে অবস্থিত হামহাম জলপ্রপাত।

| চারিদিকে এক শীতল শান্ত পরিবেশ

শুধুমাত্র উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রচার প্রচারণার অভাবে বাংলাদেশের অন্যতম এই জলপ্রপাতটি আজও রয়ে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। কেবলমাত্র দৃষ্টিনন্দন ঝরনা নয়, পথের দু'পাশের বুনো গাছের সজ্জা দৃষ্টি কেড়ে নেয় অনায়াসে। জারুল, চিকরাশি ও কদম গাছের ফাঁকে ফাঁকে রঙিন ডানা মেলে দেয় হাজতো প্রজাপতি। চশমা বানরের আনাগোনা ডুমুর গাছের শাখায়। চারদিকে গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর এ বনাঞ্চল। ডলু, মুলি, মির্তিংগা, কালি ইত্যাদি অদ্ভুত নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ এ বাগানগুলোকে দিয়েছে ভিন্ন একরূপ। 

| চারদিকে গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর এ বনাঞ্চল

পাথুরে পাহাড়ের ঝিরি পথে হেঁটে যেতে যেতে সুমধুর পাখির কলরব মনকে ভালোলাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেবে। দূর থেকে কানে ভেসে আসে বিপন্ন প্রায় বনমানুষের ডাক। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর শুরুতে দু'চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাহাড় থেকে ধোঁয়ার মতো ঘন কুয়াশা ভেষে ওঠার অপূর্ব দৃশ্য। মনে হয় যেন ওই নয়নাভিরাম পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এভাবেই হাঁটতে হাঁটিতে একসময় পৌঁছে যাবে কাঙ্ক্ষিত হামহাম জলপ্রপাতের কাছাকাছি। কিছু দূর এগোলেই গুনতে পাবে হামহাম জলপ্রপাতের শব্দ। কাছে গিয়ে দেখতে পাবে প্রায় ১৫০ ফিট অপর হতে আসা জলপ্রপাতের সেই অপূর্ব দৃশ্য। প্রবল ধারায় ওপর হতে গড়িয়ে পড়ছে ধরনার পানি নিচে থাকা পাথরের ওপর। পাথরের আঘাতে জলকণা বাতাসে মিলিয়ে গিয়ে তৈরি করছে কুয়াশা। চারিদিকে এক শীতল শান্ত পরিবেশ। ডানে বামে চোখ ফেরানোর উপায় নেই কেবলই ইচ্ছে করবে তাকিয়ে থাকি সৃষ্টিকর্তর এই অনন্য সৃষ্টির জন্য। জঙ্গলে উল্লুক, বানর আর হাজার পাখির ডাকাডাকির সাথে ঝরনার ঝরে পড়ার শব্দ মিলে মিশে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ। ক্ষণিকের জন্য ভুলেই যেতে হবে কোথায় আছেন, কীভাবে আছেন। উপরে আকাশ, চারিদিকে বন, পায়ের নিচে ঝিরির স্বচ্ছ পানি আর সম্মুখে অপরূপ ঝরনা। নিজেকে না হারিয়ে আর কি কোনো উপায় আছে?

| প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির বর্ণনা শুনতে যতটা সুন্দর ও লোভনীয় মনে হয় যাত্রাপথ কিন্তু ততটাও সহজ নয়

প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির বর্ণনা শুনতে যতটা সুন্দর ও লোভনীয় মনে হয় যাত্রাপথ কিন্তু ততটাও সহজ নয়। উঁচু নিচু পাহাড় আর টিলা, বুনো জঙ্গল, পাথুরে আর কর্দমাক্ত পথ, কোথাও হাঁটু সমান আবার কোথাও কোমর সমান ঝিরিপানি। শুধু তাই নয় এই দুর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে প্রবল শত্রু হিসেবে পেয়ে যাবে অসংখ্য বন্য মশা, মাছি এবং রক্তচোষা জোঁক। এই পথ পাড়ি দিয়েছে অথচ কেউ জোঁকের কবলে পড়েনি এমনটি ভাবা স্বপ্নবিলাস। 

পাহাড়ি পথ মাড়াতে গিয়ে আপনাকে ঘাম ঝরাতে হবে, পরিশ্রান্ত হতে হবে, কখনো পিছু হটতে মন চাইবে। খাদ্য আর পানীয়ের অভাব তোমাকে কখনো অসহায় করে তুলতে পারে। তারপরও সৌন্দর্য পিপাসুদের অদম্য ইচ্ছার কাছে এইসবের কোনোকিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা।

উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে রাজকান্দি বন রেঞ্জের কুরমা বনবিট এলাকার প্রায় ১০ কিলোমিটার গহিন অরণ্যেও এই দুর্গম দৃষ্টিনন্দন হামহাম জলপ্রপাতে সরাসরি যানবাহন নিয়ে পৌঁছার ব্যবস্থা নেই। উপজেলা সদর থেকে কুরমা চেকপোস্ট পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার পাকা রাস্তায় স্থানীয় বাস, জিপ, সিএনজি ও মাইক্রোবাসে যেতে হয়। বাকি ১০ কিলোমিটার যেতে হয় পায়ে হেঁটে। সেখান থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে সীমান্ত এলাকায় ত্রিপুরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পল্লী। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা তৈনংবাড়ী কলাবন বস্তি থেকে পায়ে হেঁটে রওনা হতে হবে। প্রায় ৬ কিলোমিটার পাহাড় টিলা ও ২ কিলোমিটার ছড়ার পানি অতিক্রম করে ৩ ঘন্টা পায়ে হাঁটার পর দেখতে পাওয়া যায় ১৬০ ফুট উচ্চতার এই ঝরনা সুন্দরী হামহাম জলপ্রপাতের আঙিনা।

হামহাম যাবার জন্য সাথে একজন ট্যুর গাইড নিয়ে যাওয়া অত্যাবশ্যক। কারণ প্রথমবার যারা যাবে তাদের জন্য রাস্তা ভুল করাই স্বাভাবিক। কলাবন গেলে গাইড পাওয়া যায়। একজনকে সাথে নিয়ে যেতে পারো। গাইডকে প্রতিজনে ২০০-৩০০ টাকা দিলেই হবে। ট্র্যাকিং করার সময় সবার হাতে একটি করে বাঁশ বা লাঠি নিয়ে যাবেন। এটি ভারসাম্য রক্ষা করতে, হাঁটতে এবং সাপ বা অন্যান্য বন্যপ্রাণী হতে নিরাপদ রাখবে।

| ট্র্যাকিং করার সময় সবাই হাতে একটি করে বাঁশ বা লাঠি নিয়ে যান নিরাপত্তা ও হাটতে সুবিধার জন্য

দুপুরে খাবার জন্য হালকা শুকনো খাবার নিয়ে যাওয়া ভালো। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ডেটল, প্যারাসিটামল, তুলা এগুলো নিয়ে নিতে পারেন। বর্ষাকালে ঝরনার প্রকৃত রূপটা দেখা যায়। তবে সেক্ষেত্রে যাবার রাস্তায় কষ্ঠও বেশি হবে। শীতকালে রাস্তায় তেমন পানি থাকে না বলে যাওয়াটা একটু সহজ। কিন্তু শীতে অধিকাংশ ঝরনাতেই একদম পানি থাকে না। সেটা দেখাও খুব একটা সুখকর নয়।

হামহাম জলপ্রপাতে পৌঁছার পর অপরূপ নির্মল ওই সৌন্দর্যে নিমেষে জুড়িয়ে যায় পথের সব ক্লান্তি। শখের দু'পাশের বুনো গাছের সন্ধ্যা যে-কোনো পর্যটকের দৃষ্টি ফেরাতে সক্ষম। জরুল, চিকরাশি ও কদম গাছের ফাঁকে ফাঁকে রঙিন ডানা মেলে দেয় হাজারো প্রজাপতি। চশমা বানরের আনাগোনা ডুমুর গাছের শাখায়। চারদিকে গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর এ বনাঞ্চন। জবু, মুলি, মিটিংগা, কালি ইত্যাদি অদ্ভুত নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ এ বাগানগুলোকে দিয়েছে ভিন্ন এক রূপ। পাথুরে পাহাড়ের ঝিরি পথে হেঁটে যেতে যেতে সুমধুর শাখির কলরব মনকে ভালোলাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেয়।◾

তথ্যসূত্র: আবদুল হাই ইদ্রিছী, কিশোরকন্ঠ, এপ্রিল সংখ্যা, ২০২৫।

  

Next Post Previous Post
📢 আপনার ব্র্যান্ড/প্রতিষ্ঠানের কথা জানুক হাজারো অনলাইন পাঠক আজই বিজ্ঞাপন দিন 🛍️