লংলার জমিদার কন্যা করিমুন্নেছার পরকিয়ার বলি আরেক জমিদার কটু মিয়ার করুণ কাহিনী

‘‘লংলা গাঁইয়া বেটি গো উঁচাত বাঁন্ধো খোঁপা, হাইর গলাত ছিয়া ফালাইয়া দেশো রাখছো খোঁটা’’
সিলেট অঞ্চলে বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ, মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার প্রত্যন্ত এলাকা লংলার এক কলঙ্কিনী নারীকে উদ্দেশ্য করে উক্ত প্রবাদটির সূচনা। প্রবাদটি শুদ্ধ বাংলায় দাঁড় করালে যেমনটা হয় তা হলো, "লংলা গ্রামের বেডি নাকি উঁচুতে বাধোঁ খোঁপা, স্বামীর গলায় ছিয়া ফেলিয়া তুমি দেশে রাখছো খোঁটা"। 

প্রবাদটির মর্মার্থ হলো, লংলার ঐ নারী তার স্বামীকে হত্যা করে সারা দেশের কাছে  লংলার নারীদের জন্য কলঙ্কের চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। যাকে উদ্দেশ্য করে এই প্রবাদের জন্ম, তার নাম করিমুন্নেছা।

নির্মাতা শাকুর মজিদের করিমুন্নেছা টেলিফিল্মে মূখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শূদ্র দেব ও তারিন

রাজা সুবিদনারায়ন-এর চতুর্থপুত্র ঈশা খাঁ বংশীয় দেওয়ান মোহাম্মদ মনসুর ওরফে কটুুমিয়া বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার (প্রাচীন ইটা পরগণা) লংলা ইউনিয়নের কানাইটিকর গ্রামের নজম্বর আলি চৌধুরীর কন্যা করিমুন্নেছার রুপে-গুণে  মুগ্ধ হয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। কনে পক্ষ বরের বংশগৌরব এবং প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যান। সে সময় কনের মতামত নেওয়ার কোনো রেওয়াজ ছিল না।

জমিদারকন্যা হলেও আভিজাত্যের প্রতি কোনো মোহ ছিলো না তার। বরং প্রজাদের প্রতি জমিদারদের অত্যাচারের গল্প শুনে তার মন কেঁদে উঠতো। ধনী-দরিদ্রের ভেদা-ভেদ ছিলো না তার মনে। সবাইকেই সমান চোখে দেখতেন, ভালোবাসতেন। ভালোবাসার কাঙাল-এ করিমুন্নেছা- পুরো সিলেটে যেনো এক ঘৃণিত চরিত্র হয়ে উঠলেন। হৃদয়ের ভালোবাসাই যেনো তাকে ঘৃণার পাত্রীতে পরিণত করেছেন।

করিমুন্নেছা ছিলেন প্রাণচঞ্চল একজন কিশোরী। মন দিয়ে বসেছিলেন বাবার সেরেস্তাদারকে (হিসাবরক্ষক)। নাম তার কানুরাম দাস। অবসর সময়ে ঐ সেরেস্তাদার পড়া দেখিয়ে দিতেন করিমুননেছাকে। পাঠের ফাঁকে ফাঁকে মনের অজান্তেই মন বিনিময় হয়ে যায় দু’জনের। দু’জনের মনের ঘরে ভালোবাসা বাসা বাঁধলেও কেউই কাউকে মুখ ফোঁটে কিছু বলেননি সাহসের অভাবে। এরই মাঝে বিয়ে ঠিক হয় করিমুন্নেছার। পাত্র ইটা পরগণার জমিদার দেওয়ান মো. মনসুর ওরফে কটু মিয়া। বাবা দেওয়ান মো. সাকির মিয়ার মৃত্যুর পর তিনি একাই সামলাচ্ছেন ইটা পরগণার বিশাল জমিদারি। ইটা রাজ্য বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি প্রাচীন স্বাধীন রাজ্য, যা বর্তমান সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কিয়দংশ নিয়ে গঠিত ছিলো। বাৎস্য গোত্রীয় দ্বিজ নিধিপতির মাধ্যমে ১১৯৫ খ্রিস্টাব্দে পত্তন হওয়া এই রাজ্যের রাজধানী স্থাপিত হয় ভূমিউড়া এওলাতলী গ্রামে।

এদিকে বিয়ের খবরে কান্নার ঢেউ ভাঁঙে করিমুন্নেছার চোখে। বুকে যেনো হাতুড়ির আঘাত পড়তে থাকে। ভালোবাসার মানুষটিকে ছেড়ে যেতে মন মানছিল না কিছুতেই। কিন্তু উপায় নেই বাবার কথা উল্টানোর। কাউকে বললেও কিছু হবে না। বুকের ব্যথা বুকে রেখেই মেনে নেন নিজের নিয়তি। বিয়ের পর বাবার বাড়ি ছেড়ে করিমুন্নেছার ঠিকানা হয় ইটায়। একা সংসারে ভালো লাগে না করিমুন্নেছার। স্বামীরও সময় নেই তাকে সময় দেওয়ার। স্বামী ব্যস্ত তার জমিদারি নিয়ে। ভোগ-বিলাসেও কিছুটা সময় কাটে কটু মিয়ার। 

স্বামীর সংসারে ভালোবাসার দেখা পেলে হয়তো প্রথম প্রেম ভুলেও যেতেন করিমুন্নেছা। একাকিত্ব তার প্রেমকে আরো জাগিয়ে তুলে। বিয়ের পর বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসে করিমুন্নেছার দেখা হয় তার সাবেক গৃহশিক্ষক বা প্রেমিকের সাথে। বুকে চাপা রাখা ভালোবাসা ফুলে উঠে জোয়ারের মতো। করিমুন্নেছা সিদ্ধান্ত নেন আর ফিরে যাবেন না ইটায়। এরই মাঝে ঘোড়া দৌড়ে নবাবী কায়দায় কটু মিয়া বেড়াতে আসেন লংলায়। শ্বশুরবাড়িতে রহস্যজনক মৃত্যু হয় কটু মিয়ার। সন্দেহের তীর ধেয়ে যায় করিমুন্নেছার দিকেই। এ মৃত্যু নিয়ে সিলেটে অনেক লোকগল্প প্রচলিত আছে, কোনো কোনো গল্পমতে খোঁপার কাঁটায় গেঁথে করিমুন্নেছাই হত্যা করেন কটু মিয়াকে। কোনো কাহিনী বলছে, গলায় ধান ভানার লাঠি (ছিয়া) চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে কটু মিয়াকে হত্যা করেন করিমুননেসা। আবার কোনো কাহিনী অনুসারে শরবতের সাথে বিষ খাইয়ে স্বামীকে হত্যা করেন করিমুননেসা।

তবে তাদের পরবর্তী বংশধরদের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এবং ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মতে জানা যায়, এ বিয়েতে করিমুন্নেছার মতামত ছিল না। ফলে জোর করে বিয়ে দিলেও করিমুন্নেছার মন উতলা হয়ে থাকত প্রেমিক কানু দাশের জন্য। তিনি পথ খোঁজতে থাকেন কিভাবে এ পাতানো বিবাহবন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়। কিন্তু মুক্ত হওয়া সহজ ছিল না। তাই করিমুন্নেছাকে বাধ্য হয়ে কটুমিয়াকে হত্যার পরিকল্পনা করতে হয়। এবং হত্যার স্থান হিসেবে বেছে নেন কানাইটিকর গ্রামের বাপের বাড়ীকে। অর্থাৎ ফিরাযাত্রায় বাপের বাড়ি নাইওর গিয়ে অসুস্থতার অজুহাতে স্বামীর বাড়ী ফিরে আসতে দেরী করেন। কটুমিয়া নববধূও দূরে থাকা ও বিরহ জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ১৮৭০ সালে (১২৭৭ বাংলার শ্রাবণ মাসে) নিজেই করিমুন্নেছাকে নাইওর থেকে আনতে যান। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেই রাতেই করিমুন্নেছা ও তাঁর প্রেমিকের যোগসাজসে কটুমিয়াকে প্রথমে বিষপান করিয়ে পরে ধান ভানার মোটা লাঠি দিয়ে গলা চেপে (আঞ্চলিক ভাষায়, গলায় ছিয়া ফেলে) শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে; পরের দিন ভোরে প্রচার করা হয় যে, ওলাওঠা রোগে (কলেরা) আক্রান্ত হয়ে কটুমিয়ার মৃত্যু হয়েছে। ওদিকে গোসল দেয়ার সময় লোকেরা কটুমিয়ার গলায় ক্ষত চিহ্ন দেখতে পান। ফলে তাদের সন্দেহ জাগে এবং এ নিয়ে করিমুন্নেছার বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ময়নাতদন্তে ধরা পড়ে কটুমিয়াকে প্রথমে বিষপ্রয়োগ ও পরে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়।

১৮৭০ সালের এ ঘটনায় মামলা উঠে সিলেটের আদালতে। করিমুন্নেছা তখন আত্মগোপনে। তাকে ধরার জন্য পুরস্কারও ঘোষিত হয়। পুলিশ কিছুতেই নাগাল পাচ্ছিলো না করিমুন্নেছার। 

তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রশাসন  করিমুন্নিসাকে ধরার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। তখন সুনামগঞ্জ থানার দারোগা ছিলেন গোলাপগঞ্জ থানার ভাদেশ্বর পরগণার দক্ষিণভাগ গ্রামের আহসান চৌধুরী। তিনি এ মামলাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে তদন্তভার গ্রহণ করেন। কিছু দিন পর করিমুন্নিসাকে ধরা সহজ নয় বুঝতে পেরে তিনি পীরের ছদ্মবেশ ধারণ করেন। আহসান রেজা কলকাতা হুগলী মাদ্রাসা থেকে আলীম পাশ করেন। ফলে পীরের নিঁখুত অভিনয় করা তার পক্ষে ছিল সহজ, কেননা, তাবিজ-কবজ ও ঝাড়ফুঁক দেয়া, কিংবা সুরা-কেরাত পড়া ওয়াজ-নসিহত করা ইত্যাদিতে পারদর্শী ছিলেন বলে তাঁকে ভণ্ড হিসেবে ধরার কোনো উপায় ছিল না।
 
জনশ্রতি আছে যে, তাঁর সেই অভিনয় থেকে নাকি অনেকে অনেক উপকার লাভও করেন। (ধারণা করা হয় উপকারীরা ছিলেন গোয়েন্দা পুলিশেরই লোক) ফলে চারিদিকে পীরের নাম-ডাক পড়ে যায়। ওদিকে স্বামীকে নিজ হাতে হত্যা করা থেকে পাপবোধে ভীত হয়ে, থানা-পুলিশের তাড়া খেয়ে এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে পালাতে পালাতে করিমুন্নেছা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন। তাঁর পরিবারও এ মামলা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল। ফলে করিমুন্নিসা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। একসময় করিমুন্নিসার কানে খবর পৌছে যে, পাশের গ্রামে এক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী পীর এসেছেন, তিনি সকল জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারেন। খবর পেয়ে করিমুন্নেছা তাকে ডেকে পাঠান মানসিক যন্ত্রণা এবং মামলা নামক আপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। কিন্তু কারো সমস্যা সমাধান করানোর আগে পীরের শর্ত ছিল প্রথমে জীবনের পাপের কাহিনী খুলে বলতে হবে। নতুবা তিনি কারো জন্য কিছুই করতে পারবে না। আর করলেও কাজের কাজ কিছুই হবে না। সে জন্য করিমুন্নেছা পীরকে  বিশ্বাস করে তাঁর গত জীবনের পাপের কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করেন। পীরও বুঝতে পারেন তার সাফল্য আসন্ন। তিনি পরবর্তী অমাবশ্যার রাতে করিমুন্নিসার সকল মুসকিল আসান করার আশ্বাস দিয়ে থানায় খবর পাঠান-কীভাবে কি করতে হবে। নির্ধারিত রাতে করিমুন্নেছা পীরের কাছে এলে, নিয়মমাফিক পীর পর্দার আড়াল থেকে তাঁর ডান হাত কাপড় দিয়ে মুড়ে পীরের হাতে রাখার নির্দেশ দেন। করিমুন্নেছা ডান হাত বাড়িয়ে দিতেই পীর শক্ত করে ধরে হুইসেলে ফুৎকার ছাড়েন, সাথে সাথে পুলিশ দল এসে করিমু্িন্নেছাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আহসান রেজা চোধুরী তাঁর সাফল্যের জন্য ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত হন।

সিলেট জজকোর্টে মামলা চলাকালীন সময়ে করিমুন্নেছার পক্ষে কোনো কৌসুলী বা উকিল কেউ ছিলেন না। তৎকালীন ইংরেজ জজ কবার্ণ সাহেবের আদালতে করিমুন্নেছা, কানুরাম দাস এবং তার আরো দুজন সহযোগীসহ মোট চার জনকে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।

জানা যায়, ফাঁসির আগে শেষ ইচ্ছে কী তা  জানতে চাওয়া হলে করিমুন্নেছা নাকি বলেছিলেন, তিনি তার রূপের বাটা বা প্রসাধনীর বাক্সে পান খেতে চান। তাঁর সেই সাধ পূরণ হয়েছিল কি-না তা জানা যায়নি।
 
ফাঁসির পর করিমুন্নেছার মরদেহ গ্রহণের কোনো লোক ছিল না। ফলে বেওয়ারিশ হিসেবে তাঁর মরদেহ সিলেট শহরের অদূরে ষোলঘর মৌজায় দাফন করা হয়। 

সিলেটের ইতিহাসে একসাথে চারজন লোকের ফাঁসির ঘটনা ছিল সেই প্রথম। সেজন্য ঘটনাটি সারাদেশ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। কথিত আছে করিমুন্নেছাকে ধরার পরে কলঙ্কিনী হিসেবে তাঁর চুল কেটে আলাদা করা হয়েছিল। ফাঁসির পরে দীর্ঘদিন তাঁর সেই চুলগুচ্ছ সিলেটের চাঁদনিঘাটে আলী আমজাদের বিখ্যাত ঘড়িঘরের ভিতরে রাখা ছিল। 

জমিদারদের অত্যাচার, নাচঘরে বাঈজি নাচানো, মদ খেয়ে বুদ হয়ে প্রলাপ বকা, ইচ্ছামত একের পর এক বিয়ে করা, গরিব দুঃখী প্রজা, দাসী-বাদীদের নীপিড়ন-নির্যাতন করে উল্লাস প্রকাশ এবং জমিদারি বাড়ানোর স্বপ্ন দেখা ব্যতিত (দু-একজন ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তি ছাড়া) যাদের জীবনে আর কোনো স্বপ্ন নেই। সেই সামান্তবাদী অচলায়তন থেকে করিমুন্নিসা মুক্তি চায়, চায় আরও দশজনের মতো মুক্ত সাধারণ জীবন, বাঁধতে চায় মনের মানুষকে নিয়ে একটি সুখের নীড়। কিন্ত সেই অচলায়তন থেকে বের হয়ে আসা সহজ ছিল না। কারণ জমিদারের কাছে জমিদার ছাড়া আর কারো কথার কোনো মূল্য নেই, নেই পরিবার পরিজনের কোনো মৌলিক অধিকার; তাদের কাছে পাপ-পূণ্য বলেও কিছু নেই। কাম চরিতার্থ করার সময় তারা স্ত্রীকে যেমন ভালবাসে, তেমনি ভালবাসে দাসীবাদী কিংবা বাঈজীকে। এজন্য করিমুন্নিসার খেদোক্তি, ‘জমিদারের ঘরে জন্ম হওয়াই আমার ঠিক হয় নাই’। ‘জন্ম যেন তাঁর আজন্ম পাপ’।

‘কলঙ্কিনী’ করিমুন্নেছাকে কেউ আর স্মরণ করে না। কিন্তু ইতিহাসে ভালোবাসার এক ‘নিষিদ্ধ’ নাম হয়েই টিকে আছেন।

সিলেটের মানুষ এ ঘটনাকে সিলেটের আঞ্চলিক ঘটনা হিসেবে জানলেও সিলেট ছাড়া দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষ এ ঘটনাকে ময়মনসিংহের কাহিনী বলে জানেন। কারণ ড. দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর মৈমনসিংহ গীতিকায় কাহিনীটাকে ময়মনসিংহের এবং লোকবিজ্ঞানী ড. আশরাফ সিদ্দিকী তাঁর লোকসাহিত্য গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ এলাকার কাহিনী বলে লিপিবদ্ধ করেছেন। সুতারাং কাহিনীটি যে ময়মনসিংহ জেলার নয় এবং কাহিনীটি কী, তা যে সকল পাঠক জানেন না, তাদেরকে অবহিত করা। লোক-কবিরা এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচনা করেন বহু গান ও কবিতা। হয়েছে পালাগান, যাত্রাগানসহ বহু নাটক এবং সেই থেকে আজ পর্যন্ত কাহিনীটি গল্পের মতো বলা হয়ে থাকে।

ইতিহাস হচ্ছে, কালানুক্রমিক অতীত ঘটনা অর্থাৎ যখন যা ঘটেছিল তখন তার বিবরণ।  পক্ষান্তরে ইতিকথা ইতিহাস আশ্রয়ী হলেও কিংবদন্তীনির্ভর। সে হিসেবে করিমুন্নেছার গ্রাম্যগীতিটা ইতিহাস নয়, বরং কিংবদন্তী বলা যায়। কারণ তা ইতিহাস হিসেবে কোনো গ্রন্থে লিখে রাখা হয়নি। ইতিহাস হিসেবে যদি কিছু থেকেও থাকে, তাহলে তা হচ্ছে সিলেট জজকোর্টের ফাইলপত্রে, যা জনসাধারণের নাগালের বাইরে। সুতারাং করিমুন্নিসা যে কাহিনী আমরা শুনে থাকি তা আসলে ইতিহাস নয়, কিংবদন্তিনির্ভর ইতিকাহিনী।

আর সেই ঐতিহাসিক লোক কাহিনীটিকে নিয়েই টেলিফিল্ম তৈরি করেছেন নাট্যকার ও জনপ্রিয় নির্মাতা শাকুর মজিদ। তার নামানুসারে টেলিফিল্মের নাম "করিমুন্নেছা" রাখা হয়। 

শাকুর মজিদ করিমুন্নিসাকে একজন স্বাধীনচেতা সংগ্রামী নারী হিসেবেই দেখাতে চেয়েছেন। যার একটি সরল মন আছে, আহ্লাদ আছে, মানবিক গুণাবলী আছে, আছে মধ্যযুগীয় সামান্তবাদী ঘূণেধরা সমাজব্যবস্থা থেকে বের হয়ে স্বাধীনভাবে নিজের মতো করে একজন পূর্ণাঙ্গ নারী হয়ে ওঠে জীবন-যাপনের অদম্য স্পৃহা এবং তা বাস্তবায়নের প্রাণান্তর চেষ্টা। আর সে চেষ্টা বাস্তবে রূপান্তরিত করতে না দিয়ে সমাজ করিমুন্নেছার মতো একজন সহজ-সরল নারীকেও হিংস্র করে তুলেছিল, বাধ্য করেছিল নর হত্যায়। এটা কি তাঁর অপরাধ? হয়তো হ্যাঁ, হয়তোবা না! কেন না, ন্যায়-অন্যায়ের হিসাবকে কোনো প্রচলিত ছকে ফেলে বিচার করা অসম্ভব। 

দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘অপরাধের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে সমাজ, আর সেই সমাজে একজন অপরাধী তার কর্তব্য সম্পাদন করে মাত্র।’ তাহলে, করিমুন্নেছা কি তার কর্তব্য সম্পাদন করেছিলেন মাত্র?

যে কোনো হত্যাকাণ্ডই অপরাধ, সে হিসেবে করিমুন্নেছাও সমাজ এবং আইনের চোখে অপরাধী এবং এজন্য তাঁর শাস্তিও হয়েছে।
 
কিন্ত তা বড় অমানবিকভাবে অর্থাৎ অপরাধের জন্য সমাজ তাঁর চুল কেটেছে, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনো আইনজীবী নিয়োগ না করে বরং একতরফাভাবে বিচার নামক প্রহসনের মাধ্যমে তাঁর প্রাণদণ্ড দিয়েছে; এমনকি সেদিন তাঁর মৃত দেহটি গ্রহণ করে সৎকার করার মতো কোনো মানুষ ছিল না, তাই বেওয়ারিশ হিসেবেই তাঁর লাশ দাফন করা হয়। বিবেকহীন সমাজ সেই দৃশ্যটি উপভোগ করেছে এবং তিলকে তাল করে প্রচার করেছে। এর পরেও জয় ঠিকই হয়েছিল করিমুন্নেছার। কারণ সে বিবেকের কাছে হার মেনেছে সত্যি, কিন্তু সামন্তবাদী সমাজের কাছে হার মানেনি। তাঁর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধসে পড়ে বিলীন হয়ে গেছে ইটার জমিদার কটুমিয়া এবং লংলায় নজম্বর আলি চৌধুরীর তথাকথিত অভিজাত দুটি পরিবার; এটাই বা কম কীসের।

Next Post Previous Post
📢 আপনার ব্র্যান্ড/প্রতিষ্ঠানের কথা জানুক হাজারো অনলাইন পাঠক আজই বিজ্ঞাপন দিন 🛍️