"সে মৃত মানুষের মাংশ-কলিজা খায়", বাংলাদেশের নরখাদকের লোমহর্ষক সত্য ঘটনা ও বিনি সুতোয় ঘর বাঁধার গল্প

‘সে মরা মানুষের মাংস ও কলজে ছিঁড়ে খায়!’  এই অদ্ভুত শিরোনামে খবর ছাপায় তৎকালীন প্রথম সারির একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা। সেই দৈনিকের প্রথম পাতায় দেখা যাচ্ছিলো, টগবগে এক মধ্যবয়সী যুবক, একটা লাশের কাটা-ছেঁড়া করা দেহ থেকে কলিজা বের করে খাচ্ছে। 

বাংলাদেশের নরখাদকের লোমহর্ষক সত্য ঘটনা ও বিনি সুতোয় ঘর বাঁধার গল্প

শুধু রাজধানী শহরই নয়, পুরো দেশজুড়ে এই ভয়ানক অদ্ভুত কান্ড নিয়ে শুরু হয় হুলস্থুল অবস্থা! এ ঘটনায় প্রশাসন ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে অস্বাভাবিকভাবেই বিড়ম্বনা পোহাতে হয় ! 

বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা ও ঘটনাপ্রবাহে পুরো ৭৫ টাই যেন ছিল অভিশপ্ত! এই ১৯৭৫ সালের এপ্রিলের ৩ তারিখ, “দৈনিক বাংলা” প্রথমই প্রতিবেদন ছাপায় এই খইল্লা পাগলা বা খলিলুল্লাহকে নিয়ে! 

এ শিরোনামে খবরটি ছাপা হওয়ার পরও প্রশাসন ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের টনক নড়তে দুদিন সময় লেগে যায়। ভয়ানক শিহরণ জাগানো এই ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই জনসাধারণের মাঝে তখন বেশ সাড়া ফেলেছিল। একে একে বের হয়ে আসে খলিলুল্লাহকে নিয়ে নতুন নতুন সব গল্প! আর গণমাধ্যমগুলোও একে একে ছাপাতে থাকে তার রোমাঞ্চকর ও লোমহর্ষক গল্প। 


খলিলুল্লাহ ওরফে খইল্যা পাগলা; ছবি: দৈনিক বাংলা


অবশেষে গ্রেপ্তার করা হয় খলিলুল্লাহ নামের এই নরখাদককে এবং মানসিক চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় পাবনা মানসিক হাসপাতালে।

যেভাবে সে নরখেকো হলো

দৈনিক বাংলায় সংবাদটি ছাপা হওয়ার পর গণমাধ্যমে রীতিমতো তোলপাড় শুরু হয়।

এরইমধ্যে খলিলুল্লাহ নরমাংসের নেশায় মর্গে আসতেই হাসপাতাল কর্মচারীরা তাকে ধরে ফেলেন। 

তারপর তাকে হাসপাতালের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক কর্নেল এম. এল রহমানের কক্ষে হাজির করা হয়। কর্নেল সাহেব ডেকে পাঠান কলেজের অধ্যক্ষ ডা. এম. এ. জলিল, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সামাদসহ আরো কয়েকজন মানসিক বিশেষজ্ঞকে। তাঁরা খলিলুল্লাহকে অভয় দিয়ে ঘটনা খুলে বলতে বললে অনেক চাঞ্চল্যকর কাহিনী বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে। 

তার জবানবন্দিতেই তা জানা যাক বিস্তারিত।

সে সসময় ঢাকা মেডিকেল কলেজে রবি নামে একজন ডোম ছিল। 

সে লাশ কাটাঁ-ছেড়া করতো। রবি ডোম আর খলিলুল্লাহ ছোটবেলায় বন্ধু ছিল। 

তখন সে লালবাগ এলাকায় থাকত। 

সেখান থেকে প্রতিদিন হেঁটেই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতলের মর্গে আসত। 

রবি ডোমের বাবা ছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রথম ডোম। 

সে-ই খলিলুল্লাহ ও রবি ডোমকে প্রথম মরা মানুষের মাংস খেতে দিত। 

পরে রবি ডোম নরমাংস খাওয়া ছেড়ে দেয়। 

কিন্তু খলিলুল্লাহ তা ছাড়তে পারেনি। 

অন্তত ১৫ দিন পর পর তার নরমাংস চাই চাই'ই। 

শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ নয়, মিটফোর্ড হাসপাতালের গোপাল ডোম ও সোনা ডোম তাকে মরা মানুষের মাংস খেতে দিতো।

নরমাংস ছাড়াও লাশের কাফনের কাপড় চুরি করা তার নেশা। ঢাকার বিভিন্ন কবরস্থান থেকে কবর খুঁড়ে কাপড় এনে তা মৌলভীবাজারের কাছাকাছি পুরনো কাপড়ের দোকানে বিক্রি করত। 

কাপড় বিক্রির টাকা দিয়ে স্বাভাবিক খাবার খেত।

খলিলুল্লাহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আরো বলেছে, সে তার খালা মমিনাকে মানুষের মাংসকে খাসির মাংস বলে রান্না করিয়ে খেয়েছে। 

এসব রোমহর্ষক তথ্য শুনে ঢাকা মেডিকেল কর্তৃপক্ষ রীতিমতো হতবাক হয়ে যায়। এরপর তার দেওয়া বর্ণনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তাৎক্ষণিক হাসপাতালের রান্নাঘর থেকে মুরগির কাঁচা মাংস এনে দেওয়া হয় তাকে। 

সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে মুরগির কাঁচা মাংস উপস্থিত চার ডাক্তারের সামনেই চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে।

এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়, খলিলুল্লাহকে আর জনসমক্ষে রাখা যাবে না।

পরে সে জ্যান্ত মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, এ আশঙ্কায় পুলিশ ডাকা হলো। 

পুলিশ এসে খলিলুল্লাহকে হাতকড়া লাগিয়ে রমনা থানায় নিয়ে যায়। শুরু হয় নতুন করে পুলিশি জেরা। কিন্তু পুলিশকে অবাক করে খলিলুল্লাহ দৃঢ়কণ্ঠে বলে, সে মানুষের মাংস খায়, ভবিষ্যতেও খাবে! এ কথা বলার পর পুলিশ নিশ্চিত হয়, খলিলুল্লাহ কোনো দাগী বা ক্রমিক আসামি নয়, সে একজন জটিল মানসিক রোগী।

মানসিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে ঢাকার আদালতে পাঠানো হয়। সবকিছু শুনে বিচারক খলিলুল্লাহকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর নির্দেশ দেন।

১৯৭৫ সালের তোলপাড় করা নরমাংস খাওয়ার ঘটনা সারা দেশে লোকমুখে ফিরতে ফিরতে একসময় পর্দার আড়ালে চলে যায়। 

মানসিক চিকিৎসার জন্য খলিলুল্লাহকে পাবনা পাঠানোর মাধ্যমে ঘটনাটি সময়ের সাথে মিলিয়ে যেতে থাকে। 

তবে যারাই ঘটনাটি শুনেছে, তাদের মনে তা বিভীষিকার সূচনা করেছে।

১৯৯৭ সালের দিকে অনেকটা কাকতালীয়ভাবে আজিমপুর কবরস্থানের গেটে দৈনিক বাংলা'র প্রতিবেদকের সঙ্গে নরমাংসখেকো খলিলুল্লাহর সাক্ষাৎ মেলে। লম্বা, বয়সের ভারে কিছুটা কুঁজো, চাপ দাড়িওয়ালা, লুঙ্গি-শার্ট পরিহিত খলিলুল্লাহ নিজেকে সুস্থ বলে দাবি করে। 

আজিমপুর কবরস্থানে সারাদিন ঘুরে বেড়াত খলিলুল্লাহ

তবে সুস্থ হলে এখনো কেন কবরস্থানের আশপাশে ঘুরে বেড়ায়, এ প্রশ্নের জবাবে সে বলে তার কোনো আত্নীয়স্বজন বা জ্ঞাতিগোষ্ঠীর সন্ধান সে জানে না। 

কেউ তার খোঁজ নিতেও আসেনি। 

যার কারণে কবরস্থানের এখানে-সেখানে সে ঘুরে বেড়ায়। মানুষ তার পরিচয় পেয়ে দুই-চার টাকা সাহায্য দেয়। তা দিয়ে তার পেট চলে যায়।

রাতে কবরস্থানের বাইরে যেকোন জায়গায় সে ঘুমিয়ে পড়ে। মানুষের মাংস ও কলিজা খাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে খলিলুল্লাহ প্রথমে কিছুটা ইতঃস্তত বোধ করে। পরে তাকে পেটপুরে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। এতে বেশ কাজ হয়। অনর্গল বলে যায় সেই পুরনো দিনের কথা। তবে কেন সে নরমাংস খেত, তা ঠিকমতো বলতে পারেনি। হঠাৎ মাথায় গণ্ডগোল হলে সে কী করত তা নিজেই অনুভব করতে পারত না।

তবে খলিলুল্লাহ প্রতিবেদকের কাছে আরো জানায়, পাবনা মানসিক হাসপাতালের চিকিৎসায় সে ভালো হয়ে যায়; কিন্তু কলিজাখেকো বলে কেউ তাকে কাজ কিংবা আশ্রয় দেয়নি। অনেকে শারীরিকভাবে আঘাতও করেছে। যার জন্য শুধু বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে কবরস্থানকেই সে বেছে নিয়েছে। তবে মরা মানুষের মাংসের লোভে নয়, শুধু নিজেকে সমাজ থেকে দূরে রাখার জন্য।

"যদি মানুষের মাংস খাওয়ার জন্যই কবরস্থানে আসি, তাহলে তো কবরস্থান কর্তৃপক্ষ অনেক আগেই আমাকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিত" বলে সে দাবি করে। 

তবে দৈনিক বাংলা কিংবা সাপ্তাহিক বিচিত্রায় তাকে নিয়ে যখন প্রচ্ছদ করা হয়, তখন সে ছিল উন্মাদ।

প্রতিবেদক আরিফুর রহমান যখন খলিলুল্লাহকে বললেন তাকে বেশি বেশি লাশ খেতে দেওয়া হবে, তখন সে লাফ দিয়ে উঠে বলেছিল, -‘স্যার, আমাকে লাশ খেতে দেবেন?’'

হা-হা বলে তখন সে একটা অট্টহাসিও দিয়েছিল।

এরপর প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাব দেয়।

প্রশ্ন : এখন বল, তুই সত্যিই লাশ খাস?

উত্তর : হ, খাই ।

প্রশ্ন : কেন খাস?

উত্তর : ভালো লাগে।

প্রশ্ন : না খাইয়া থাকতে পারস না?

উত্তর : মাইনষ্যার মাংস না খাইলে পাগল অইয়া যাইমু।

প্রশ্ন : শোন, কয়দিন পর পর খাস?

উত্তর : দুই।  (আঙুল দিয়ে দুই দেখাল)

প্রশ্ন : কয়দিন আগে খাইছিস?

উত্তর : পরশু দিন। একটা মাইয়া খাইছি। কইলজা চিবাইয়া, স্যার। (মুখে হাসি)। তেল (নরমাংশের চর্বি) খাইতে পারি।

প্রশ্ন : কি খাইতে ভালো লাগে, কইলজা না তেল?

উত্তর : এইখানের মাংস। (হাত দিয়ে ঊরু দেখাল)।

প্রশ্ন : শোন, আর মাংস খাবি না বুঝলি। আর খাবি?

উত্তর : খামু।

প্রশ্ন : কেন, তোর খারাপ লাগে না? গন্ধ আসে না?

উত্তর : হা হা, ভালো লাগে।

এরপর প্রতিবেদক মজা করে বললেন, "তুই যে মানুষের মাংস খাস, তা কি বাস্তবে দেখাতে পারবি?"

সঙ্গে সঙ্গে খলিলুল্লাহ মেডিকেলের মর্গের ভেতরে ঢুকে ছুরি দিয়ে এক টুকরো মাংস নিয়ে আসে। 

সঙ্গে কলিজার টুকরোও। 

তার সামনেই পৈশাচিকভাবে কলিজার টুকরো কচঁ-কচিঁয়ে খেতে লাগল। এরপর প্রতিবেদক খলিলুল্লাহকে ডেকে ২০ টাকা দিলেন, যাতে ঘটনাটি অন্য কোনো সাংবাদিককে না বলে। 

তবে খলিলুল্লাহর শর্ত ছিল একটাই সাংবাদিককে মর্গের ডোম রবিকে বলে দিতে হবে তাকে যেন মরা মানুষের কলিজা বেশি খেতে দেয়। 

এ প্রতিবেদক ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে খলিলুল্লাহকে পেয়ে পুরনো ঘটনার অবতারণা করলে তার চোখ চঞ্চল হয়ে ওঠে। 

২০০৫ সালে মারা যায় সে। 

বছর দুয়েক আগে স্মৃতিতে আবারও ফিরে আসে খলিলুল্লাহ। অতৃপ্ত মনের নরমাংস খাওয়ার নেশা যেন চোখেমুখে প্রকাশ পায়। পুরনো অভ্যাসটা এখনো ভুলতে পারেনি। তবে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। বলে, স্যার অতীতকে ভুলতে চাই। সভ্য হয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাঁচতে চাই।

স্বঘোষিত ও প্রমাণিত নরমাংসখাদক খলিলুল্লাহ'র আত্মপরিচয় সম্পর্কে অনেক খোঁজ-খবর নিয়েও কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। 

তবে দৈনিক বাংলার মেডিক্যাল কলেজ প্রতিনিধি আরিফুর রহমানের কাছে সে স্বীকার করেছে, তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদী এলাকায়। বাবার নাম আব্দুল মান্নান। গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে প্রথমে বিভিন্ন বাসায় চাকরের কাজ করত। কিন্তু বাসায় কাজ করতে গিয়ে মনিবের প্রহারে তার মাথায় গণ্ডগোল দেখা দেয়। 

এর পরের ঘটনা তার মনে নেই।

খলিলের নতুন জীবন

সে মানুষের মাংশ কাঁচা চিবিয়ে খেতে আত্মতৃপ্তি পেত, যার নাম শুনলেই একসমর দশকে যার নাম বলে মানুষে শিশুদের ঘুম পাড়াত, সে ব্যক্তিটি শেষ জীবনে মৃদুভাষী একজন ভাবুকে পরিণত হয়েছিল। 

সভ্য সমাজের ভদ্রলোকেরা তাকে ঘৃণায় দূরে ঠেলে দিলেও, আজিমপুর কবরস্থানে ভাগ্যবিড়ম্বিত কিছু ভিক্ষুক কাছে টেনে নিয়েছিলেন। 

বেঁচে থাকার জন্য ভিক্ষুকের সারিতে বসে খলিলুল্লাহ ভাবত বিগত দিনে যে লোমহর্ষক ঘটনা সে ঘটিয়েছিল, সেটা কি আসলেই সত্য?

- "আমার দিকে মানুষ এমনভাবে তাকিয়ে থাকে কেন? অন্য কারো দিকে তো অদ্ভুত দৃষ্টিতে এভাবে তাকিয়ে দেখে না"।

খলিল মনে মনে ভাবে, - "আমি কি তাহলে ভিন্ন প্রকৃতির কোনো লোক"? 

এই প্রশ্নের জবাব মেলে সহযোগী ভিক্ষুক কমলা আক্তারের কাছ থেকে।

 - ‘'তুমি তো আগে পাগল ছিলে, মানুষের মাংস এবং কলিজা খেতে। তোমার নাম শুনলে অনেকে ভয় পায়। তবে তুমি এখন ভালো হয়ে গেছ।’' 

কোনো কথা বলত না খলিল। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত কমলার দিকে। সবাই দূরে চলে যায়, কথা বলতে চায় না, শুধু কমলাই তার খোঁজ-খবর নেয়; খাওয়া-দাওয়া হয়েছে কি না।

অসুস্থ হলে কয়েকবার দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাইয়েছেন কমলা আক্তার।

এসব ভাবতে ভাবতেই তার মনে প্রেমভাব জাগ্রত হয়ে ওঠে। ভিক্ষুক সারিতে বসে মনের ভাব আদান-প্রদান আর সুখ-দুঃখের কথা ভাগাভাগি করতে গিয়েই পাশের ভিখারিণীকে তার ভালো লেগে যায়। জীবনের শেষ অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরে তাকে। ব্যাপারটা তার সহকর্মীরাও বুঝে যান। তাই দুজনকে এক করে সংসার বাঁধার ব্যবস্থা করে দেন অন্য ভিক্ষুকরা।

প্রথম দিকে দুজন কবরস্থান গেটে বসে সময় কাটালেও একপর্যায়ে কামরাঙ্গীরচরে বস্তিঘরে সংসার শুরু করেন। দুজনের ভিক্ষাবৃত্তি দিয়ে অনেক কষ্টে জীবন যাপন করার পরও কোনো অনৈতিক কাজে লিপ্ত হননি তাঁরা। তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁদের সুখী সংসার গড়ে ওঠে। যে খলিলুল্লাহ মর্গ আর কবরস্থানে মরা মানুষের মাংস খুঁজে বেড়াত, সে মানুষটি প্রেমের টানে সংসারের বিনি সুতায় আটকা পড়ে যায়।

আজিমপুর পুরনো কবরস্থানে ভিক্ষুকদের যাঁরা খলিলুল্লাহর সহযাত্রী ছিলেন, তাঁরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, বিয়ে করার পর সে একজন অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিল। কারো সঙ্গে খারাপ আচরণ তো দূরের কথা, সে কোনো মানুষের সঙ্গে প্রয়োজনের বেশি কথা বলত না। কামরাঙ্গীরচরে বাসা ভাড়া নেওয়ার পর ভিক্ষাবৃত্তি শেষে সোজা চলে যেত সেখানে। অনেকে রাস্তায় দেখে তাকে মানুষের কলিজাখেকো হিসেবে তিরস্কার করলেও সে মাথা নিচু করে চলে যেত। একজন আদর্শ সংসারি হিসেবে খলিলুল্লাহ জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করে।

খলিলুল্লাহর শেষ জীবন

কবরস্থানের গেটের ভেতরে যেতেই বর্ষীয়ান খাদেম মো: নাজেম সাহেবের সঙ্গে দেখা। 

তিনি এখানে ৩০ বছর ধরে মুর্দাদের দাফন-কাফনের কাজ করছেন। খাদেম নাজেম নামেই তাঁকে সবাই চেনে। নরমাংসখেকো'র কথা বলতেই তিনি মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, - "খইল্লা পাগলার কথা বলছেন তো? শেষ জীবনের বছরগুলো কেটেছে এ কবরস্থানের গেটেই। লম্বা কিছুটা কুঁজো মানুষটি সারাক্ষণ চুপচাপ বসে থাকত। বিকেলে কবরস্থানের দিকে শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখত। লাশ দাফন কিংবা কবর জিয়ারত করতে আসা লোকজনের ভিক্ষায় তার পেট চলত।"

খলিলুল্লাহ পাবনা মানসিক হাসপাতাল থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ঢাকায় আসে; কিন্তু মানুষের মাংস খাওয়ার অপবাদ তার কপাল থেকে যায়নি। কোথাও গেলে তাকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হতো। মহল্লার লোকজন ইট দিয়ে তাকে আঘাত করত।

ঘৃণায় তাকে কেউ কাজ দিত না। যার কারণে আজিমপুর করবস্থানের গেটে বসে সে ভিক্ষা করত। সমাজ থেকে বিতাড়িত হয়েই সে কবরস্থানের ভিক্ষুকদের মধ্যে স্থান করে নিয়েছিল।

আজিমপুরের আদি বাসিন্দা আবুল কাশেম জানান, চার থেকে পাঁচ বছর আগেও লম্বামতো একটি লোক খালি পায়ে মহল্লার এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াত। মানুষের কাছে হাত পেতে খাবার সংগ্রহ করত। পরে জেনেছি সে নর মাংসখেকো খলিলুল্লাহ; কিন্তু সব সময় চুপচাপ বসে সে যেন কী ভাবত।

কাউকে ধমক দেওয়া কিংবা গালি দেওয়ার কথা শোনা যায়নি। তবে তার চোখমুখের দিকে তাকালে বোঝা যেত, একসময় মানুষটি হিংস্র ছিল। চোখের ভাষায় বলে দিত তার পক্ষে লাশ খাওয়া অসম্ভব ছিল না।

কবরস্থানে কর্তব্যরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সবার কাছে সে "খইল্ল্যা পাগলা" নামে পরিচিত ছিল। তবে কখনো তাকে পাগলামি করতে দেখা যায়নি। গেট পেরিয়ে কবরস্থানে তাকে কখনো ঢুকতেও দেওয়া হয়নি। এমনকি সেও কখনো কবরস্থানের ভেতরে ঢুকার আবদার করেনি।

২০০৫ সালের দিকে মৃত্যুর আগে তার জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। কয়েক বছর নানা রোগে ভুগে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। তার বড় ছেলে রমজান আলী জানায়, টাকার অভাবে বাবার চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। মুখে পানি এসে হাত-পা ফুলে গিয়ে মারা যান। তবে চিকিৎসার খরচের জন্য দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি। কেউ কেউ খলিলুল্লাহর সন্তান বলে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে।

খলিলুল্লাহর স্ত্রী নূরজাহান বেগম অনেক কষ্ট স্বীকার করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বামীর পাশে ছিলেন। তিনি জানান, "খলিলুল্লাহর স্ত্রী বলে কত লাঞ্ছনা-গঞ্জনা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে তার কোনো শেষ নেই। সাহায্য চাইতে গেলে অনেকে গলাধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। খলিলুল্লাহকে মানুষখেকো হিসেবে লোকজন ধিক্কার দিলেও সে যে কত ভালো মানুষ ছিল স্ত্রী হিসেবে আমার চেয়ে আর কেউ ভালো জানত না।

তার মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর সে কী করেছে তা তার মনে ছিল না। তবে সুস্থ হয়ে ওঠার পর সে একজন সম্পূর্ণ অন্যরকম মানুষ হয়ে গিয়েছিল। সন্তানদের সে খুব আদর করতো।"

নূরজাহান বেগমও বর্তমানে বৃদ্ধ। তাঁর দুই ছেলে রমজান আলী ও রাজ্জাক হোসেন ছোটখাটো কাজ করে কোনোরকম সংসার চালাচ্ছে। কামরাঙ্গীরচরের পূর্ব রসুলবাগের এক বস্তিতে মাত্র দেড় হাজার টাকা ভাড়ায় বসবাস করছে। বছরের অধিকাংশ সময় নূরজাহান বেগম অসুস্থ থাকেন। তবে তিনি কারো কাছে নিজেকে খলিলুল্লাহর স্ত্রী বলে পরিচয় দিতে পারেন না।

পরিচয় দিলে মানুষখেকোর বউ বলে লোকজন হেয় চোখে দেখে। তিনি বলেন, আজিমপুর কবরস্থানের মানুষগুলোর ভালোবাসায় খলিলুল্লাহ সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পেরেছিল। তা না হলে সে আবার অসুস্থ মানুষ হিসেবে আগের জীবনে ফিরে গেলে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।

রমজান ও রাজ্জাক তাদের বাবাকে নিয়ে গর্ব করে। কারণ আর দশজন বাবার মতো তাদের বাবাও তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছেন। স্নেহ-ভালোবাসা দিয়েছেন। আবার প্রয়োজনে শাসনও করেছেন। বাবা যে মানুষের মাংস খেতেন, তার আচরণ দেখে তার সন্তানদের বর্তমানে তা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়।

রমজান বলে, সেই ছোটবেলায় বাবা একদিন না দেখলে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিতেন। একদিন আমার প্রচণ্ড জ্বর। ওষুধ খাওয়ার পরও ভালো না হওয়ায় আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করেন। কখনো ধমক দিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন না। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হতেও দেখিনি। এত ভালো মানুষ কিভাবে মানুষের মাংস খেতেন আমি ভাবতেই পারি না।

[ বি : দ্র : ফিচারের তথ্যগুলো বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য ব্লগ ও ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত। ] 

banner
Next Post Previous Post
📢 আপনার ব্র্যান্ড/প্রতিষ্ঠানের কথা জানুক হাজারো অনলাইন পাঠক আজই বিজ্ঞাপন দিন 🛍️