পরাজয়ে কাতর ভারত, পাকিস্তানের জয়ে ভারতীয়দের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া

মার্কিন মধ্যস্থতায় গত শনিবার সন্ধ্যায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি ঘোষণা এবং কার্যকরের পর পাকিস্তানজুড়ে শুরু হয়েছে বিজয় আর আনন্দ উৎসব। 

| পরাজয়ে কাতর ভারত, পাকিস্তানের জয়ে ভারতীয়দের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া

রোববার (১১ মে) 'ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা' জানানোর দিন হিসেবে ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার। পাকিস্তানের জনগণ ও সরকার আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে তাদের বিজয়ী বীর সেনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ দিয়েছেন বিজয় ভাষণ। অন্যদিকে পরাজয়ের গ্লানি আর হতাশায় ডুবেছে ভারত। প্রচণ্ড চাপের মুখে এখন মোদি সরকার।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে 'অপারেশন সিঁদুর' পরিচালনার আগে ভারতের সব রাজনৈতিক দল দাঁড়িয়েছিল মোদি সরকারের পাশে। এখন তারাই সরব হয়ে জবাব চাইছে- কেন এমনটি হলো? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বইছে সমালোচনার ঝড়। পাকিস্তান যখন বিজয়োল্লাস করছে, ঠিক সে সময় পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি-পরবর্তী আলোচনায় করণীয় ঠিক করতে মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ব্যস্ত নরেন্দ্র মোদি। সব মিলিয়ে পরাজয়ের দুঃখে এখন কাতর ভারত।

ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস অপারেশন সিঁদুর, এর ফলাফল এবং যুদ্ধবিরতিসহ সার্বিক বিষয়ে আলোচনার জন্য সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকার দাবি জানিয়েছে। এ ব্যাপারে বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধী চিঠি দিয়েছেন সংসদ নেতা নরেন্দ্র মোদিকে। শিবসেনাসহ অন্যান্য কট্টরপন্থি রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাশাপাশি ভারতের ক্ষুব্ধ জনগণ মোদি সরকারকে 'গাদ্দার' আখ্যা দিয়ে তার পদত্যাগের দাবি তুলেছে। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি এবং কাশ্মীরকে নতুন করে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত করায় রীতিমতো উদ্বিগ্ন ভারতের অনেক নীতিনির্ধারক। তারা প্রশ্ন তুলছেন-কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে মার্কিন মধ্যস্থতা কীভাবে মেনে নিল মোদি সরকার।

রাহুল গান্ধী নরেন্দ্র মোদিকে দেওয়া চিঠিতে তার উদ্বেগের কথা জানিয়ে বলেছেন, যুদ্ধবিরতি ও পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে করণীয় ঠিক করতে অবশ্যই সংসদের বিশেষ অধিবেশন জরুরি। বর্তমান পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাজ্যসভার বিরোধীদলীয় নেতা ও কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেও রাজ্যসভার বিশেষ অধিবেশনের দাবি জানিয়েছেন। চিঠিতে তিনি বলেছেন, পেহেলগাম হত্যাকাণ্ড, অপারেশন সিঁদুর এবং যুদ্ধবিরতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতে হবে। কংগ্রেস নেত্রী সুপ্রিয়া শ্রীনাথ সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, মোদিকে জবাব দিতে হবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কীভাবে ভারতের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন।

কংগ্রেস নেতা শচীন পাইলট তার গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়ে বলেছেন, আমরা সরকারকে সব ধরনের সমর্থন দিলাম, যাতে তারা পাকিস্তানকে 'শাস্তি' দিতে পারে। কিন্তু দেখতে পেলাম যুক্তরাষ্ট্র এসে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করছে। ওই যুদ্ধবিরতি ঘোষণায় তৃতীয় দেশে বসে আলাপ-আলোচনার কথা বলা হয়েছে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। কাশ্মীরের আন্তর্জাতিকীকরণ আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়ার বদলে এখন কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় বসা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

কংগ্রেসের অন্যতম প্রভাবশালী এমপি মনীষ তিওয়ারি বলেছেন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতে সব সময় বাইরের শক্তি হস্তক্ষেপ করেছে- এটাই বাস্তব সত্য। 

১৯৯০ সালের পর থেকে যখনই উত্তেজনা হয়েছে, তখনই হস্তক্ষেপ হয়েছে। এবারও সেটা আমরা দেখলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও যেভাবে যুদ্ধবিরতির কথা বলেছেন, তা আমরা কীভাবে মেনে নিতে পারি। আমরা তো এখানে যুদ্ধবিরতি শব্দটাকে মানতে পারছি না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কাশ্মীর সমস্যার ব্যাপারে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা মেনে নেওয়া যায় না।

শিবসেনার প্রভাবশালী নেতা সঞ্জয় রাউত মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, ভারতের মাটিতে ভারতের হিন্দুরা মারা গেল, তার বিরুদ্ধে সরকার কী করল? মোদি সরকার এতই দুর্বল যে, আমেরিকাকে শেষ পর্যন্ত ডেকে আনতে হলো। মোদি সরকার অপারেশন সিঁদুরের নামে আমাদের মা-বোনদের সিঁদুরকে অপমান করেছে। আমাদের জওয়ানদের মনোবল ভেঙে দিয়েছে। দেশের সঙ্গে রীতিমতো গাদ্দারি করেছে মোদি সরকার। হিন্দু সংস্কৃতিকে অপমান করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা তো বদলা নিতে চেয়েছিলাম। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম আমাদের সৈন্যরা করাচি, লাহোর এবং পাকিস্তানের অন্যান্য শহরে হামলা করছে। কিন্তু আমরা কী দেখলাম! সরকার কি বদলা নিতে পেরেছে? অমিত শাহের সেই হুংকার এখন কোথায়? আমরা এই গাদ্দারদের পদত্যাগ চাই।

যুদ্ধবিরতির সমালোচনা করে শিবসেনার এই নেতা বলেন, যুদ্ধবিরতির প্রশ্ন কেন এলো? আসলে মোদি ও তার সহযোগীরা নিজেদের জীবন ও সম্পদ বাঁচাতে যুদ্ধবিরতি করেছে। আমরা যখন দেখলাম দিল্লি, হরিয়ানা ও গুজরাট পাকিস্তানের টার্গেটে পরিণত হয়েছে, তখন নিজেরা বাঁচতে এই যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছে। আমি চ্যালেঞ্জ করছি, সাহস থাকলে মোদি এখন সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য সর্বদলীয় বৈঠক ডাকুন।

ভারতের জনপ্রিয় ইউটিউবার অভিসার শর্মা রীতিমতো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, এটা কী হলো! আমরা জয়লাভের ঠিক আগ মুহূর্তে পরাজিত হয়ে গেলাম। আমাদের মানুষ মারা গেল। আমাদের ওপর হামলা হলো। ডেকে আনা হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে। ট্রাম্প বললেন কাশ্মীর হাজার বছরের পুরোনো সমস্যা। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বক্তব্যের মাধ্যমে কাশ্মীর ইস্যুকে আন্তর্জাতিক ইস্যু বানিয়ে ফেললেন আর মোদি সরকার এখানে একেবারেই চুপ। আমরা কী অর্জন করলাম! পাকিস্তান একটি 'সন্ত্রাসী দেশ'। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এসে পাকিস্তান আর ভারতকে সমমর্যাদায় দাঁড় করিয়ে দিলেন। এ ব্যাপারে বিজেপি সরকারকে জবাব দিতে হবে। আমরা দেখলাম, তুরস্ক ও চীনসহ অনেকেই পাকিস্তানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমরা ইসরাইল ছাড়া কাউকেই পেলাম না। এরও জবাব দিতে হবে মোদি সরকারকে।

এদিকে ভারতের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। এরপর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে নিয়ে চলছে নানা ধরনের ট্রল। অনেকেই বিক্রম মিশ্রিকে ভীরু, কাপুরুষ এবং গাদ্দার হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

গতকাল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর কিংবা নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের কাছ থেকে কোনো ধরনের বক্তব্য আসেনি। শুধু প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি সেখানে বলেছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে টের পেয়েছে। রাজনাথ সিংয়ের এ বক্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তৈরি হয়েছে হাস্যরস। জিৎ নামে একজন লিখেছেন- এই রাজনীতিবিদদের কারণেই আমাদের জওয়ানরা আজ মনোবল হারিয়ে ভেঙে পড়েছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url