ঠগী: ভারতবর্ষের এক কুখ্যাত খুনে সম্প্রদায় | SAYEED's Blogspot | Written by Sayeed Al Islam

সপ্তদশ শতাব্দীর ভারতবর্ষ। পথের ক্লান্তিতে অবসন্ন এক পথিক দূর পথে হাঁটছে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। একটু পরে পায়ে চলা রাস্তা পেরিয়ে আর একটু চওড়া একটা রাস্তায় পড়তেই দেখল একটা কাফেলা কোথায় যেন যাচ্ছে। অন্তত, শ’খানেক লোক তো হবেই। বেশির ভাগই পুরুষ হলেও, মেয়ে আর বাচ্চারাও আছে। খুবই আলাপী মনে হল তাদের। বিশেষ করে দলের সর্দার সৌম্যদর্শন মানুষটি।

ঠগী: ভারতবর্ষের ভয়ঙ্কর এক খুনে সম্প্রদায় 

পথিককে দেখেই এগিয়ে এসে আলাপ জমালো। গন্তব্যের কথা শুনে বললো, তারাও ঐদিকেই যাচ্ছে। পথিককেও তাদের দলে ভিড়ে যাবার পরামর্শ দিল সর্দার।

banner

আজ রাতটা কোনরকম কাটিয়ে কাল পৌছে যাবে গন্তব্যে। দলটাকে বেশ ভাল লাগল পথিকের। রাজস্থানি পোশাক পরা পুরুষেরা, মাথায় পাগড়ি, বাচ্চাদের সাথে নিয়ে মেয়েরা আছে দলের পিছন দিকে। সবাই হাঁটছে, দলের সাথে দু-একটা মালবাহী গাধা । খাবারের সময় এলো- ‘গরিবরা যা খাবে, তা-ই একটু মুখে দিতে হবে। নইলে, মা ভবানী (হিন্দুদের কালী দেবী) রাগ করবেন।’, দলের সর্দার বললো পথিককে। 

বোঝা যায় দলের ভেতর হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মের অনুসারীই আছে। রুটি-মাংস দিয়ে খাবার শেষ হয়। বিকেলে দলে আরো কিছু সদস্য বাড়ে। তারা চারজন ব্যবসায়ী বলেই মনে হয়। সঙ্গে ঘোড়ার পিঠে বাক্স। মনে হল, তারা একটু ইতস্তত করছিল, কিন্তু সর্দারের প্রাণখোলা আমন্ত্রণ ফেরাতে পারেনি। সর্দারই বলল, পথেঘাটে ডাকাতের ভয়। এক সঙ্গে চলাই ভাল। নতুন করে দল বাড়ায় সবাই মনে হল দারুণ খুশি। চলতে চলতে সন্ধ্যা নেমে এল। এবার রাতের মতো থামা। সুন্দর একটা আমবাগানে তাঁবু পড়ল। ঠাণ্ডাটা বাড়ছে। কাপড় পেতে জমিয়ে বসল দলটা। একটু দূরে রান্নার আয়োজন শুরু করল মেয়েরা। বাতাসে গরম রুটির ঘ্রাণ। কাঠকুটো কুড়িয়ে এনে আগুন জ্বেলে দিল ফাই-ফরমাশ খাটার ছোকরা দুটো। সর্দারের গল্প চলছেই। পুরোনো কালের গল্প। গল্পে-গল্পে সময় যেন পিছিয়ে গেছে দেড়শো-দুশো বছর পূর্বে। রুটি, সবজি এলো গরম গরম। 

যে মেয়েটি নিয়ে এলো, তার মুখটা লাল হয়ে উঠেছে, বোধহয় তাওয়ার আঁচে। চোখের দিকে তাকালো না। ত্রস্ত পায়ে ফিরে গেল তাঁবুর পিছনে। 

খিঁদের মুখে গরম রুটির নেশা, আহা! খাওয়া শেষে গান শুরু হল। কি আনন্দ জীবনে! ব্যবসায়ী চারজনও তামাক টানছে। উষ্ণ আতিঁথেয়তার উত্তাপ যেন সবাইকে ঘিরে- নিশ্চিন্ত মনে আছেন সবাই। অপরিচিত হলে কী হবে, রক্ত সম্পর্ক ছাড়াই যেন একটা অলিখিত আত্মীয়তার বন্ধনের আবদ্ধ হয়েছেন সবাই। এদিকে সর্দার যেন কাকে বললো,              - ‘ যাও, বাসন মেজে আনো।’ 

ঘুমে পথিকের চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল, হঠাৎ কানে এল, ‘সাপ’ ‘সাপ’ বলে চিৎকার। চোখ খুলতেই সর্দারের বাজখাঁই গলায় শুনলো, ‘তামাকু লাও।’ ঠক করে গলায় যেন কী টান লাগলো। তারপর সবকিছু চিরদিনের জন্য অন্ধকার!

বছর ধরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় হারিয়ে যেত অগণিত পথিক। কোথায়, কীভাবে হাড়াতো, জানতো না কেউ। কোন এক জাদুবলে যেন তারা মুছে যেত পৃথিবীর বুক থেকে, এই পথিক আরো চার ব্যাবসায়ীর মত করে।  কত মানুষ হারিয়েছিল এই ভাবে? গিনেস বুকের হিসাবে এই সংখ্যা ২০ লক্ষ ছাড়িয়েছে! নিরিহ পথিকদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যেয়ে হত্যা করে তাদের মালামাল লুট করত যারা, ভারতীয় কিংবদন্তীতে সেসব গোষ্ঠীকে ঠগী বলা হত। ভারতবর্ষ তথা পুরো বিশ্বে অন্তত এমন নজির নেই। ইতিহাসে কিংবদন্তী উপাখ্যানে পরিনত হয়েছে এরা।

এই সেই ঠগী, যারা ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম খুনিদের মধ্যে অন্যতম বলে চিহ্নিত। সতেরো ও আঠারো শতকের প্রথম দিকে ভারতের পথিকদের জন্য মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম ছিল। ঠগীরা সবসময় চলতো দল বেঁধে। একলা পথিক পেলেই সাদরে তাকে দলের সাথে ভ্রমণের আমন্ত্রন জানাত। সহযাত্রীদের সৌহার্দ্য, নিরাপত্তা আর বিশ্বাসের উষ্ণ আমেজে ভূলিয়ে, পথ চলার ক্লান্তিতে ঢুলে পড়া মাত্রই করতো শিকার। গরম খাবার পেটে পড়ায় বন্ধ হয়ে আসত চোখ। তখনই আসত সর্দারের হুকুম, বাসন মেজে আনার। খাবার পর বাসন মাজার ব্যপারটা অতি স্বাভাবিক নির্দেশ। বাসন মেজে আনা কথাটি ছিল একটি সাংকেতিক বাক্য। হত্যার পর লাশ গুম করার জন্য একদল কবর আগে থেকেই কবর খোঁড়ার কাজে নিয়োজিত থাকতো। কিন্তু কবর তৈরি করার দায়িত্ব যার, সে জানতো সময় ঘনিয়ে আসছে। অর্থাৎ হত্যার আদেশ আসবে। সে আদেশ হল ‘তামাকু লাও’।

গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করতো ঠগীরা

ঠগীরা ছিল ভারতীয় খুনি সম্প্রদায় (Cult); ভারতবর্ষে ঠগীরা যত মানুষ হত্যা করেছিল, পৃথিবীর কোনও সংগঠিত খুনি সংঘ এতো নিরীহ মানুষ হত্যা করেনি। কেবল ১৮৩০ সালেই ঠগীরা প্রায় ৩০ হাজার মানুষ গামছা পেচিঁয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে মৃতদেহ উৎসর্গ করত দেবী কালীর নামে। 

হয়তো কোনও প্রকারে হত্যাপ্রবন ঐ আদিম রীতিটি ভারতীয় সমাজে তখনও টিকে গিয়েছিল। আদিম সমাজে মানুষ তো মানুষের মাংসও খেত। 

প্রাচীন মায়া সভ্যতায় মায়া-অ্যাজটেকরা উপড়ে নিত জীবন্ত মানুষের হৃৎপিন্ড। ঠগীদের নৃশংস ইতিহাস ভারতীয় ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। আজও গ্রামবাংলার মানুষের মুখে মুখে ফেরে ঠগীদের রোমহর্ষক কাহিনী । 

ঠগীদের নৃশংস ইতিহাস ভারতীয় ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। আজও গ্রামবাংলার মানুষের মুখে ফেরে ঠগীদের রোমহর্ষক কাহিনী । ঠগীদের নির্মম কাহিনী অবহিত হওয়ার পর ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ইম এম ফস্টার ১৯২৪ সালে অত্যন্ত খেদের সঙ্গে বলেছেন: ‘গড ইজ লাভ। ইজ দিস দ্য ফাইনাল মেসেজ অভ ইন্ডিয়া?’ ঈশ্বর প্রেমই কি ভারতের চূড়ান্ত বক্তব্য? ফস্টার ভুল করেছিলেন। কেননা, এমনটি মনে করার কোনও কারণ নেই যে কালীসাধক মাত্রেই খুনি, ভারতবর্ষের কালীসাধকদের একটি ক্ষুদ্র অংশই কেবল কালীসাধনার অপব্যাখ্যা করে খুনি হয়ে উঠছিল। 

ঠগীর দল 

বাংলা অভিধানে ঠগী বলতে বোঝায়, বিশেষ শ্রেনির দস্যুদল যারা পথিকের গলায় রুমাল বা কাপড় জড়িয়ে হত্যা করত। ঠগী বলতে আরও বোঝায় বোঝায়- ঠগীর কার্য, দস্যুবৃত্তি। ঠগী শব্দটি সংস্কৃত ঠগ শব্দ থেকে এসেছে। ঠগ অর্থ, ঠক বা প্রতারক বা ধূর্ত বা প্রবঞ্চক। ভারত শাসনের সূত্রে যে সকল শব্দ ইংরেজি ভাষায় যুক্ত হয়েছে Thud (থাড) তাদের একটি। শব্দটির মানে, ধপ করে পড়া বা আঘাত করা। শব্দটি নিয়ে আমরা কৌতূহলী হতে পারি যেহেতু শব্দটি সংস্কৃত ঠগী শব্দ থেকে এসেছে।

ঠগীরা তেরো শতক থেকে উনিশ শতক বাংলাসহ উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। ঠগীদের সম্বন্ধে ব্রিটিশ সরকার প্রথম জানতে পারে ১৮১২ সালে । রাজ্যের নানা স্থানে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যার করার সংবাদ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছায় । কর্তৃপক্ষ প্রথম প্রথম বিষয়টি আমলে নেয়নি, ভেবেছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ১৮১২ সালের দিকে গঙ্গার ধারে একটি গণকবরে একত্রে ৫০ টি মৃতদেহ পাওয়া যায় । গনকবরটি পরীক্ষা করে দেখা গেল যে মৃতদেহগুলি যাতে ভালো করে মাটির সঙ্গে মিশে যায় সে জন্য অত্যন্ত সচেতনভাবে কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, হাড়ের সন্ধিস্থলগুলি ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে, যাতে করে ডিকম্পোজিশন প্রক্রিয়াটি তরান্বিত হয় এবং যাতে কবর ফুলে না ওঠে এবং মৃতদেহগুলি শেয়ালে না খায়। এসব বিচারবিশ্লেষন করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ অনুমান করে গনহত্যার পিছনে রয়েছে খুনে কালট। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ঠগী নামে খুনে এক উন্মাদ গুপ্ত ধর্মীয় গোষ্ঠীর কথা। এরা ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায়, যাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। তারপর সময় সুযোগমতো পথিকের গলায় রুমাল বা কাপড় পেচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে তারপর গোপনে মৃতদেহ সমাহিত করে। যে কারণে কেউ ঠগীদের আক্রমনে মারা গেলে বিষয়টি অজানা থেকে যেত। লোকে ভাবত পথিমধ্যে জন্তুজানোয়ারের আক্রমনের শিকার হয়েছে। কিন্তু যখন বৃটিশ পর্যটক নিখোঁজ হতে শুরু করে তখন তদন্ত শুরু হয়। যানা যায় হত্যাকারীরা আদিম কালীউপাসক গোষ্ঠী। বাংলার ঠগীরা কালীকে ভবানী বলে। ঠগীরা কেবল সনাতন ধর্মেরই অনুসারী নয়, এদের মধ্যে মুসলিম ও শিখও রয়েছে!

ঠগীরা বংশপরম্পরায় খুন ও দস্যুবৃত্তি করত। ছোটবেলা থেকেই ঠগী পিতা ছেলেকে শেখাত কীভাবে শ্বাসরোধ করে ফাঁস দিয়ে হত্যা করতে হয়। ঠগী বালকের শিক্ষা শুরু হত দশ বছর বয়েসে । তখন সে লুকিয়ে হত্যাকান্ড দেখত । বয়স ১৮ হলে হত্যার অনুমতি পেত। সাধারণত শক্ত কাপড়ের তৈরি হলুদ রঙের রুমাল ফাঁস গলায় পেঁচিয়ে হত্যা করা হত। হলদে রুমাল থাকত ঠগীদের কোমড়ে । কেন ফাঁস দিয়ে হত্যা? কেননা, কালীর আদেশে রক্তপাত নিষিদ্ধ। ঠগীদের আদিপিতাই নাকি কালীর কাছে শিখেছিল ফাঁস দিয়ে হত্যার রক্তপাতহীন পদ্ধতি। ডাহা মিথ্যে কথা। যিনি মানুষ হত্যায় প্ররোচিত করেন তিনি অন্তত দেবী নন। আগেই বলেছি, ভারতবর্ষের কালীসাধকদের একটি ক্ষুদ্র অংশই কেবল কালীসাধনার ভ্রান্ত্র ব্যাখ্যায় বশেই খুনি হয়ে উঠছিল। মৃতদেহ উৎসর্গ করা হত কালীকে, কেবল লুঠের মাল ভাগ করে নিত না। এজন্যই তারা ছিল বিশেষ একটি কাল্ট বা উপাসক সম্প্রদায়।

ঠগীরা ব্যবসায়ী তীর্থযাত্রীর কিংবা সৈন্যের ছদ্মবেশে ভ্রমন করত। এদেরই লোকজন গোপনে বাজার কিংবা সরাইখানা থেকে পথযাত্রীদের সম্বন্ধে খুঁটিনাটি তথ্য যোগার করত। তারপরে যাত্রীদের সঙ্গে মিশে যেত। যাত্রাবিরতিতে হত্যাকান্ড ঘটাত। একজন যাত্রীকে খুন করত তিনজনের একটি দল। একজন মাথা ঠেলে দিত, অন্যজন ফাঁস পরাত, অন্যজন পা চেপে ফেলে দিত। কেউ পালিয়ে গেলেও রক্ষা নেই, ঠগীদের অন্যদলটি কাছেপিঠেই ওত পেতে থাকত। তবে ঠগীরা যে কাউকে হত্যা করত না। যেমন, ফকির সংগীতজ্ঞ নৃত্যশিল্পী ঝারুদার তেল বিক্রেতা কাঠমিস্ত্রী কামার বিকলাঙ্গ কুষ্ঠরোগী গঙ্গজলবাহক ও নারী। তবে ব্যবসায়ীদের স্ত্রীদের হত্যা করতে হত।

ঠগীরা প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত । অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে ঠগীদের হত্যাকান্ড তুঙ্গে উঠলেও ১৩ শতক থেকেই উত্তর ভারতে ঠগীদের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। আর বাংলায়? অনুমান করা যায় ঠগীরা পূর্বে দিল্লির আশেপাশে ছিল এবং ১২৯০ সালের পর বাংলায় আসে। ১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানি “ফিরোজ শাহর ইতিহাস” গ্রন্থে লিখেছেন: ‘...উক্ত সুলতানের শাসনামলে (১২৯০) কয়েকজন ঠগীকে দিল্লিতে আনীত হইয়াছিল এবং উক্ত ভ্রাতৃসংঘের একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া আরও সহস্র ঠগীকে আটক করা হয়। সুলতান তাহাদের হত্যার নির্দেশ দেন নাই। সুলতান উহাদিগকে নৌকায় করিয়া লক্ষণাবতীতে পাঠাইয়া দিতে নির্দেশ দেন যেন তাহারা আর দিল্লিতে গোলযোগ না করে।’ এখন প্রশ্ন হল লক্ষণাবতী কোথায়? লক্ষণাবতী বা লখনৌতি হল গৌড় বাংলা। যা অবস্থিত ছিল বর্তমান পশ্চিম বাংলার মালদা জেলায়। বাংলায় ঠগীদের ইতিহাসের সূত্রপাত তা হলে ১২৯০ সাল থেকেই? ১২৯০ সালে বাংলায় মুসলিম শাসনের ৮৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতবর্ষে রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। যাত্রীরা পায়ে হাঁটার বদলে রেলে ভ্রমন করতে শুরু করে। ঠগীদের দৌরাত্ব কমে আসছিল। এরপরও বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যাচ্ছিল গনকবর। ব্রিটিশ সরকার ঠগীদের নিমূর্ল করার উদ্যোগ গ্রহন করে উইলিয়াম শ্লিমান কে দায়িত্ব দেওয়া কথা ভাবে। ১৮২২ সালে উইলিয়াম শ্লিমান বেঙ্গল আর্মির অফিসার ছিলেন। পরে তিনি সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন; তাকেই গর্ভনর জেনারেল লর্ড বেনঙ্কিট শ্বাসরুদ্ধকারী ঠগীদের নির্মূল করার নির্দেশ।

উইলিয়াম শ্লিমান। অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যাক্তি। চারটি ভারতীয় ভাষা জানতেন।

উইলিয়াম শ্লিমানই সর্বপ্রথম ঠগীদের কার্যপ্রনালী সম্বন্ধে আঁচ করতে পারেন। তিনি জানতেন ঠগীদের দমন করা সহজ না। কেননা, অন্যান্য দুস্কৃতিকারীদের থেকে ঠগীদের আলাদা করা যাচ্ছিল না। তাছাড়া সুকৌশলে অপরাধ ঢেকে রাখছিল। ঠগী মানেই তো ঠগ; তারা নিপুন ছলনাকারী। উইলিয়াম শ্লিমান গুপ্ত চর নিয়োগ করেন, গঠন করেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ পুলিশ ফোর্স (সম্ভবত র‌্যাব এর মত), বিশেষ ট্রাইবুনাল ও দ্রুত বিচার আদালত গঠন করেন। এরই পাশাপাশি উইলিয়াম শ্লিমান ঠগীদের অপরাধস্থল সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষন করে মানচিত্র তৈরি করেন এবং অপরাধের দিনক্ষণের একটি তালিকা তৈরি করেন; যার ফলে তিনি পরবর্তী গনহত্যার সময়কাল আঁচ করতে সক্ষম হন। নিজের লোকদের ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে অস্ত্রসহ পাঠান। এভাবে ১৮৩০ থেকে ১৮৪১ সালের মধ্যে ৩, ৭০০ ঠগী ধরা পড়ে। জিজ্ঞাসাবাদের ফলে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। যেমন মাত্র ২০ জনের দল ৫,২০০ পথযাত্রীকে হত্যা করেছে । ঠগী সর্দার বেহরাম ছিল ক্রমিক খুনি (সিরিয়াল কিলার); সে ১৭৯০ থেকে ১৮৩০ সাল এর মধ্যে ৯৩১ টি খুন করে! তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সে জন্য তার অনুশোচনা হয় কি না। উত্তরে বেহরাম নির্বিকার কন্ঠে বলেছিল, ব্যবসার জন্য কারা আক্ষেপ করে! যাহোক। ৫০ জন ঠগীকে গোপন তথ্যাদি দেওয়ায় ক্ষমা করা হয়। বাদবাকিদের হয় যাবৎজ্জীবন কারাদন্ড। ৫০০ ঠগীকে ঝোলানো হয় ফাঁসীতে। ফাঁসীকাষ্ঠে ঠগীরা ছিল অভিব্যাক্তিশূন্য । বরং তারা কর্তৃপক্ষের কাছে ফাঁস দিয়ে মৃত্যুর আবেদন করে, যে ভাবে তারা নিরীহ যাত্রীদের হত্যা করত!

যাই হোক। ঠগীদের যে নির্মম চিত্র তুলে ধরা হয়েছে- বর্তমানে ভারতীয় লেখকগন তার বিরোধীতা করছেন। তারা বলছেন যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই ঠগীদের অমন হিংস্র করে দেখানো হয়েছে যা মূলত ভারতকে না বোঝার জন্যই হয়েছে। ভারতীয় সমাজে গুপ্ত সংগঠনের অস্তিত্ব যেমন হাস্যকর তেমনি ধর্মীয় কারণে ধারাবাহিক লুন্ঠনও অস্বাভাবিক। ঠগীরা আসলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং অন্যদের মতোই কালী উপাসক। বাধ্য হয়ে তারা হত্যা ও লুন্ঠনের আশ্রয় নিত বটে তবে মৃতদেহ কালীকে উৎসর্গ করার বিষয়টি অবাস্তব।


হলিউডি মুভি ‘ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দি টেমপল অভ ডুমস’ এ কুড়ি শতকের কালীউপাসক ঠগীদের দেখানো হয়েছে। ছবিটি যে কারণে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।


Next Post Previous Post
📢 আপনার ব্র্যান্ড/প্রতিষ্ঠানের কথা জানুক হাজারো অনলাইন পাঠক আজই বিজ্ঞাপন দিন 🛍️