মাদাঁম ম্যারি ক্যুরি: দুইটা নোবেল যার ঝুলিতে
বিচিত্র এক আলো, চোখে না দেখা গেলেও সবকিছু ভেদ করতে পারে। সেই আলোর কাছে জামাকাপড় বা জিনিসপত্র কোন কিছুই ছাড় নেই, অগত্যা ভীত সন্ত্রস্ত নারীরা খুঁজছেন এমন অন্তর্বাস, যা আটকাবে সে আলো। মহিলারা ভীত সন্ত্রস্ত! এমন খবরে সন্ত্রস্ত হওয়াই স্বাভাবিক সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে।
৮ নভেম্বর, ১৮৯৫ সালে জার্মান পদার্থ বিজ্ঞানী উইলহেম রন্টজেন (Wilhelm Conred Rontgen) বিচিত্র ও অদৃশ্য সেই আলো আবিষ্কার করে সবাইকে চমকে দিয়েছেন । সে কেমন ধারার আলো? তা সবার অজানা! তাই রন্টজেন নাম দিয়েছেন ‘এক্স-রে’, বাংলায় যাকে বলে ‘রঞ্জন রশ্মি’। কিন্তু আজকের কাহিনীর মূল চরিত্র রন্টজেন নন বরং বিশ্বনন্দিত একজন নারী বিজ্ঞানী যিনি পরপর দু'বার পদার্থ ও রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ৮ বছরের ব্যবধানে। জীবদ্দশায় তিনি অদ্ভুত এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কম কালিমালিপ্ত হয় নি। ব্যক্তিজীবনে অনেক চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিতে হয়েছে তাঁকে। এমনকি নোবেল কমিটি কর্তৃক চিঠি লিখে জানানো হল, আপনি পুরস্কার নিতে না এলে ভাল হয়!
অদ্ভুত ও অজানা আলো অর্থাৎ রঞ্জন রশ্মির রহস্য নিয়ে গভীর গবেষণা করেছেন এ বিজ্ঞানী ও তাঁর স্বামী।
শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার হল "রেডিওঅ্যাক্টিভিটি" বা "তেজস্ক্রিয়তা"। পদার্থবিদ্যায় তার থিওরি বা ব্যাখ্যা দিয়ে নোবেল প্রাইজ পেলেন তিনিসহ স্বামী পিয়ের ক্যুরি ও ।
লোকজন তাঁকে মাদাঁম ম্যারি ক্যুরি বলে ডাকতো। তখনকার দিনে মাদাঁম শব্দটা বিবাহিত মহিলাদের নামের পূর্বে সম্মানসূচক হিসেবে বসতো। পিয়ের ক্যুরি যে শুধু তাঁর জীবনসঙ্গীই নন, তাঁর আবেগ, তাঁর ভালবাসা, তাঁর অর্ধেক আকাশ। ম্যারি'র ক্যুরি শব্দটাও প্রথম পক্ষের স্বামীর নামের শেষ অংশ থেকে প্রাপ্ত।
![]() |
বিজ্ঞানী ম্যারি ক্যুরি, ছবিসূত্র: উইকিপিডিয়া |

অষ্টাদশী ম্যারির জীবনে অবশ্য এর আগেও প্রেম এসেছিল জোরাওস্কি নামে একটা পরিবারের বড় ছেলের প্রেমে পড়লেও সেই প্রেম পরিণতি পায়নি। জোরাওস্কি পরিবারের প্রধান কর্তা তাদের সম্পর্কে বাদ সাধলেন। বাবাকে রাজি করাতে সময় চাইলেন ছেলেটি। পাঁচ বছর অপেক্ষা করলেন ম্যারি। ধনী বাবার বাধ্য ছেলে কথা দিয়েও কথা রাখে নি। ম্যারিও চিনলেন সমাজ, আভিজাত্য ও ধন-সম্পদের গুরুত্ব। অবশ্য ধন-সম্পদের প্রতি ম্যারির কোনওকালেই মোহ ছিল না বরং মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন পদার্থবিদ্যা ও অঙ্ক।
একসময়ে মারিকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। তাদের সংসারে দারিদ্রতা থাকলেও ভাই-বোনেরা সবাই মেধাবী। মারি তো সব ক্লাসে প্রথম স্থান ধরে রাখতেন। বৃদ্ধ পিতা অসুস্থতা জনিত কারণে কাজ হারিয়েছেন। মা যক্ষ্মা রোগে প্রয়াত, এক বোন টাইফয়েডে চলে গেল। কিন্তু বাবা-মায়ের সু-শিক্ষায় ভাই-বোন সবাই তুখোড় মেধাবী ছিলেন।
এদিকে ছোট বোনকে ডাক্তারী পড়ার জন্য তৈরি করতে হবে। বোন প্যারিস যাবে, তারপর যাবে মারি। বোন ডাক্তার হলেন, কারণ তিনিও জন্মগতভাবে মেধাবী। প্রায় কিছুদিন পর পিছু পিছু প্যারিস গেলেন মারি। বোনের সাথে বেশিদিন থাকতে পারলেন না। পড়াশোনা করতে তিনি প্যারিস এসেছেন, বোনের বাড়িতে থাকলে আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। উঠলেন কলেজের কাছে এক বাড়ির একখানা খুপরি ঘরে। রোজগার বলতে কলেজের ল্যাবরেটরিতে কাঁচের পাত্র ধোয়ামোছার কাজ। কিন্তু মনপ্রাণ সব পড়াশোনায়। রান্না করার সময়ও পান না। পেট ভরাতে কখনও পাউরুটি আর শুকনো ফল, কখনও পাউরুটির সাথে এক টুকরো চকলেট খেতেন।
অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট দারুণ হল। মারি ফিজিক্সের ডিগ্রিতে প্রথম। প্রথম ম্যাথমেটিক্সের ডিগ্রিতেও। এবার তাহলে পাকাপাকি কিছু কাজ করতে হবে।
পুরনো চেনা পিতৃভূমি পোল্যান্ডের ওয়ার্শ শহরে ফিরে গিয়ে কি স্কুলে শিক্ষকতা করবেন? হয়তো সেটাই করতেন!
মারির জীবন বদলে গেল অধ্যাপক পিয়ের কুরির সাথে পরিচয়ে। তিনি গবেষণা করেন। মারির তখন বয়স ২৬, পিয়ের কুরি'র ৩৫। তবুও প্রথম দর্শনে মারির মনে হল, পিয়ের যুবক, চোখেমুখে সারল্য, দৃষ্টি কিঞ্চিৎ উদাসীন, প্রথম দর্শনেই বোধহয় দুজনেই দুজনের প্রেমে পড়েন। অচিরেই সেই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। বিয়ে হল দুজনের। নবদম্পতি দুটো সাইকেল কিনলেন। তাতে চড়ে যুগলে দেশভ্রমণে বের হলেন। দু’বছর পর জন্মাল প্রথম মেয়ে। আইরিন। সাত বছর পর দ্বিতীয় মেয়ে ইভ। তারাও বাবা-মায়ের মতো মেধাবী ছিল। বড় মেয়ে আইরিন এবং জামাই ফ্রেডেরিক পেলেন পদার্থে নোবেল পুরস্কার। সেই রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি গবেষণারই সূত্রে!
ইতোমধ্যে রন্টজেনের আবিষ্কার করা ‘এক্স-রে’ পৃথিবীকে চমকে দিয়েছে।
কয়েক মাসের মধ্যে আরেক ফরাসি বিজ্ঞানী অঁরি বেকারেল পেয়েছেন আরো এক পদার্থের খোঁজ। ইউরেনিয়াম মৌল আভা বা আলো ছড়ায়। আপনা আপনি। কিন্তু কেন? জানা নেই কী সেই আলো? আলো মানে তো এনার্জি বা শক্তি।

১৬ই ডিসেম্বর, ১৮৯৭ সাল। সেই রহস্যভেদে নামলেন মারি। সঙ্গী হলেন পিয়ের। ইউরেনিয়ামের আলো বিকিরণের নাম দিলেন ওঁরা (Aura) । তীব্র রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি বা তেজস্ক্রিয়তা এতে বিদ্যমান। প্রশ্ন করা হলো, আলো কেন? মারি বললেন, ওটা পরমাণুর ভেতরের খেলা। এখন মারি-পিয়ের জানতে চান, শুধু ইউরেনিয়ামই কি আলো ছড়ায়? না-কি তেমন মৌল আছে আরও? এটা-সেটা নিয়ে পরীক্ষা। শেষে এক পদার্থ আবিষ্কার হলো। পিচব্লেন্ডি তার নাম। যা থেকে ইউরেনিয়াম নিষ্কাশন করা হয়। কুরি দম্পতি দেখলেন, পিচব্লেন্ডি'র রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ, ওই জিনিসে লুকিয়ে আছে ইউরেনিয়াম ছাড়াও অন্য কোন মৌল, যা ছড়ায় রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি। কী সেই মৌল? খোঁজ পেতে চললো মরিয়া চেষ্টা। আগুন জ্বালিয়ে বড় কড়াইয়ে মানুষসম খুন্তি নেড়ে টন-টন পিচব্লেন্ডি গলিয়ে মৌল খোঁজা হচ্ছে। দিন-রাত লাগাতার। পরিত্যক্ত এক ছাউনি ঘর ধোঁয়া-ধুলোয় অন্ধকার। অবশেষে অনেক প্রচেষ্টার পর মিললো সেই কাঙ্খিত মৌল। মারি'র মাতৃভূমি স্মরণে কুরি দম্পতি তার নাম দিলেন পোলোনিয়াম। এর কয়েক মাস পরে এই রকম আরও এক মৌলের খোঁজ মিলে। এটার নাম দেওয়া হয় রেডিয়াম।
১৯০৩ সালে রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি বা তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার, তার ব্যাখ্যা এবং প্রবল গবেষণার জন্য পদার্থে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয় তিন জনকে, যথাক্রমে বেকারেল, পিয়ের এবং মারি কুরি।
কিন্তু সুখের সেই জীবনে হঠাৎ কালো মেঘ আসলো তাদের গগনে, গাড়ি চাপা পড়ে পিয়ের চলে গেলেন চিরদিনের মতো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রাস্তায় হাঁটছিলেন পিয়ের কুরি। একটি গাড়ি এসে পিয়েরকে চাপা দিল। সাথে সাথেই হলো মর্মান্তিক মৃত্যু। সেদিন ইংরেজি ক্যালেন্ডারে ১৯০৬ এর ১৯শে এপ্রিল । খবর শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন মারি।
সকালে বের হয়েছিলেন, সন্ধ্যায় ফিরে আবার মারির হাতটা ধরতেন! কত স্মৃতি, কত আবেগ জড়িয়ে আছে তাঁর সাথে। একসঙ্গে দুজনে নোবেল পেয়েছেন। আজ সেই মানুষটিই সারাজীবনের জন্য তাঁর জীবন থেকে চলে গেল!
অসহায় মারি আর কিছু ভাবতে পারছিলেন না। স্বামী ছাড়া একাকী জীবন কাটানো বেশ কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।
কর্মক্ষেত্রে একসময় মারি সহকর্মীদের নিন্দার শিকার হলেন। প্রণয়ে জড়িয়ে পড়লেন মারির তুলনায় পাঁচ বছরের ছোট তাঁরই প্রিয় ছাত্র পল লঁজভ্যাঁ এর সাথে। তিনি বড় মাপের বিজ্ঞানী। বিবাহিত এবং চার সন্তানের বাবা লঁজভ্যাঁ দাম্পত্য জীবনে ছিলেন চরম অসুখী। স্ত্রী বিশাল ধনী পরিবারের মেয়ে। উদ্ধত ও কটুভাষিণী। পরিবারে উত্তপ্ত কথা কাটাকাটি, এমনকী ফুলদানি ছোড়াছুড়ি লেগেই থাকে। কাজের ফাঁকে তিনি ও মারি নিজেদের দুঃখ নিয়ে আলোচনা করতেন। তা থেকে ঘনিষ্ঠতা। প্রেম। নিভৃতে সময় কাটাতে দুজনে প্যারিসে এক অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করলেন। সেখানে ঘন ঘন সাক্ষাৎ। খবর পেয়ে পুরুষটির স্ত্রী অগ্নিশর্মা। রাস্তায় মারিকে দেখে হুমকি দিলেন তাঁকে খুন করবেন। আর স্বামীকে বলে দিলেন, মারির সংস্রব ত্যাগ না করলে প্রেমকাহিনি কাগজে ফাঁস করবেন। লোকলজ্জার ভয়ে লঁজভ্যাঁ মেনে নিলেন স্ত্রীর নির্দেশ। বন্ধ হয়ে গেলো নিভৃত সাক্ষাৎ।
এর মধ্যে শুরু হল মারির বিরোদ্ধে নিন্দা প্রচার। বিদেশিনি দুশ্চরিত্রা এক বিধবা কিনা চার সন্তানের জননী নিষ্পাপ এক ফরাসি রমণীর ঘর ভাঙছেন! দেশের মানুষ দেখুক, নামী ল্যাবরেটরিগুলো কেমন পরিণত হয়েছে লাম্পট্যের আখড়ায়। মারি চাইলেন যেন তাঁর ডিভোর্স তাড়াতাড়ি হয়। আর লঁজভ্যাঁ? লঁজভ্যাঁ অরাজি। জানালেন, নিজের সন্তানদের ও বিবাহিত স্ত্রীকে ছাড়তে পারবেন না তিনি। মারি সংস্রব ত্যাগ করলেন লঁজভ্যাঁর। শেষ হল একটি প্রেমকাহিনীর । সমাজের চোখে বোধহয় সেই প্রেম প্রশ্ন তুলে দিল! এদিকে ঘোষিত হয়েছে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নাম। এগিয়ে আসছে পুরষ্কার দেওয়ার অনুষ্ঠান। কিন্তু সংগঠকরা পড়লেন মহা বিপদে । তারা মনপ্রাণ দিয়ে চাইছেন পুরস্কার বিজেতাদের মধ্যে বিশেষ একজন যেন না আসেন ওই অনুষ্ঠানে। যিনি না এলে খুশি হবে নোবেল কমিটি, তিনি হলেন বিখ্যাত একজন মহিলা বিজ্ঞানী।
মাত্র আট বছর আগে, ১৯০৩ সালে তিনি পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। সে বার পদার্থে, এবার রসায়নে। মাত্র আট বছরের ব্যবধানে দু’-দু’বার দুই আলাদা বিষয়ে নোবেল। এহেন বিজয়িনীর তো মহাসমারোহে অভ্যর্থনা পাওয়ার কথা। তাঁকে কিনা চিঠি লিখে জানানো হল, আপনি পুরস্কার নিতে না এলে ভাল হয়!
নোবেল পুরষ্কার নিতে মারি শুধু সুইডেনের স্টকহোমে গেলেন না, বক্তৃতায় স্পষ্ট ব্যাখ্যা করলেন যে কাজের জন্য পুরস্কার পেলেন, তার কতটা করেছেন তিনি, আর কতটা তাঁর স্বামী।
কিন্তু মারির ভাবমূর্তি তখনও কালিমালিপ্ত। দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কারও সে কালি মুছলো না। কিন্তু মারি সেই ভাবমূর্তি উদ্ধার করলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আহত ফরাসি সেনাদের চিকিৎসায় ১৮টি ভ্যানে করে এক্স-রে মেশিন নিয়ে ছুটে বেড়ালেন লড়াইয়ের ময়দানে ময়দানে।
১৯৩৪-এর ৪ জুলাই মৃত্যুর আগে মারির সুনাম ছড়িয়ে পড়লো দেশে-বিদেশে। মৃত্যু হলো লিউকিমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে। মৃত্যুর পেছনে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ঘাঁটাঘাঁটির পরিণামকে দায়ী করেছেন বিজ্ঞানীরা। এত বছর যে বেঁচে ছিলেন সেটাই বিস্ময়ের। চলে গেলেন ৬৬ বছর বয়সে। আর একটা বছর বাঁচলে দেখতে পেতেন মেয়ে আইরিন এবং জামাই ফ্রেডেরিক পাচ্ছেন নোবেল পুরস্কার। সেই রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি গবেষণারই সূত্রে!
