ড. ইউনুস যদি বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হতেন

মেরিকান এক সাংবাদিক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় প্রশ্ন করেছিলেন, বিশ্বব্যাংক নিয়ে আপনার সর্বক্ষণ অভিযোগ। সমালোচনার বদলে বলুন, আপনি নিজে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হলে কী কী পদক্ষেপ নিতেন?

ড. মুহাম্মদ ইউনুস; ছবি: উইকিপিডিয়া

জবাবে ইউনূস সাহেব বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হলে কী করবো, তা আমি কখনও ভেবে দেখিনি। তবে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হতে পারলে বোধহয় আমার প্রথম কাজ হবে এর প্রধান কার্যালায় ঢাকায় স্থানান্তরিত করা।

banner

আমেরিকান এক সাংবাদিক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় প্রশ্ন করেছিলেন, বিশ্বব্যাংক নিয়ে আপনার সর্বক্ষণ অভিযোগ। সমালোচনার বদলে বলুন, আপনি নিজে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হলে কী কী পদক্ষেপ নিতেন? সাংবাদিক পাল্টা প্রশ্ন করলেন, এরকম একটা অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নেবার কারণটা জানতে কী পারি?

মুহাম্মদ ইউনূস উত্তর দিলেন, আসলে প্রধান কার্যালয় ঢাকা শহরে স্থানান্তরিত করলে বিশ্বব্যাংকের পাঁচ হাজার কর্মচারী সেখানে বদলী হবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবেন। সন্তানদের ঠিকমতো মানুষ করে তোলার জন্য আনন্দদায়ক এমনকি সামাজিক জীবন যাপনের জন্য ঢাকা শহরকে তারা কখনো উপযুক্ত মনে করবেন না। অতএব, অনেকেই স্বেচ্ছা অবসর নেবেন কিংবা চাকরি বদল করবেন। সেক্ষেত্রে আমার দু’টি সুবিধা। এক, যারা দারিদ্র দূরীকরণের জন্য একান্তভাবে উৎসর্গীকৃত নন তাঁদের বাদ দেয়া যাবে। দুই, সেই খালি পদগুলিতে সমস্যা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ও অঙ্গীকারবদ্ধ এইরকম কর্মী নিযুক্ত করা যাবে।

বিশ্বের ২৫টি দেশে তাঁর লেখা বই অনূদিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি বই নিউইয়র্ক টাইমসে বেস্টসেলার লিস্টে জায়গা করে নিয়েছে। কানাডার সপ্তম গ্রেডে জাতীয় পাঠ্যপুস্তকে তাঁর জীবনী অন্তর্ভুক্ত করেছে৷ কানাডার শিশু-কিশোরদের তাঁর জীবনী পড়ানো হয়। ১২ সালে গ্লাসগো ক্যালেডনিয়ান ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর বানানো হয় তাকে। যেখানে কিনা ইউনিভার্সিটির সংবিধান ছিল ব্রিটিশ নাগরিক ছাড়া ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর বানানো যাবে না। সেখানে সংবিধান পরিবর্তন করে তাকে ভাইস চ্যান্সেলরই বানানো হয়েছে।

১৯৭৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ড. ইউনূস জাতীয় ও আন্তর্জাতিকসহ প্রায় ১৫০টি পুরস্কার/সম্মাননা পেয়েছেন। তাও আবার যেনতেন পুরস্কার নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক তিনটি পুরস্কার হলো, নোবেল, অ্যামেরিকান প্রেসিডেন্টশিয়াল অ্যাওয়ার্ড এবং কংগ্রেশনাল অ্যাওয়ার্ড। ইতিহাসে এই তিনটা পুরস্কারই পেয়েছেন মাত্র ১২ জন। এরমধ্যে প্রফেসর ইউনূস একজন। বর্তমান বিশ্বের ৩৩টি দেশে ১০৪টি বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজে তাঁর নামে ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে গবেষণা হচ্ছে তাঁর কাজ, চিন্তাদর্শন এবং তাঁর সোশ্যাল বিজনেস তত্ত্ব নিয়ে। সামাজিক ব্যবসার ওপর একাডেমিক কোর্সও চালু হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সর্বশেষ অলিম্পিকে মূল থিম ছিল তাঁর সোশ্যাল বিজনেস থিওরির উপর ভিত্তি করে।

ছোটবেলা থেকেই বইয়ের পোকা ছিলেন ড. ইউনূস। তাঁর বড় ভাইও ভীষণ বইপ্রেমি ছিলেন। তাঁরা একরুমে থেকে একসাথে পড়াশোনা করতেন। যে রুমে তাঁরা পড়াশোনা করতেন তার নিচতলায় তাঁর বাবার স্বর্ণের ব্যবসার অফিস ছিল। তাঁরা পড়াশোনা করে কিনা, বাবা তা চেক করতে মাঝেমধ্যে উপরে উঠে আসলে, জুতোর শব্দ শুনে দুই ভাই তড়িঘড়ি করে অন্যসব কাজ বা নন-অ্যাকাডেমিক বই পড়া বাদ দিয়ে পাঠ্যপুস্তক নিয়ে বসে যেতেন। বাবা যখন রুমে ঢুকে দেখতেন তাঁরা পড়ছে, তখন খুশি হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে চলে যেত। সেসময় নিয়মিত পত্রিকা ও গল্পের বই পড়তে বাবার হাত থেকে বাঁচার জন্য বাসার ঠিকানা ব্যবহার না করে পাশের বই দোকানের ঠিকানা দিতেন পত্রিকার হকারদের। এই নিয়ে তাঁর আত্মজীবনীতে এই সময়টার মজার স্মৃতি তিনি এভাবে তুলে ধরেন:

'" বড়দা ও আমি হাতের কাছে বই বা পত্রিকা যা পেতাম পড়ে ফেলতাম। আমি রহস্য রোমাঞ্চ ও গোয়েন্দা কাহিনীর ভক্ত ছিলাম। বারো বছর বয়সে আমি নিজেই গোটা এক রহস্যকাহিনী লিখে ফেলেছিলাম। অবিরত পড়ার খোরাক যোগাড় করা আর আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছিল না। প্রয়োজন মেটাতে নিজেদেরই উপায় উদ্ভাবন করতে হয়েছিলো-বই কেনা, ধার করা, এমনকি চুরি পর্যন্ত। আমাদের প্রিয় শিশুপাঠ্য পত্রিকা শুকতারা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হত। তাতে নিয়মিত একটি প্রতিযোগিতা থাকত, জিতলে বিনামূল্যে পত্রিকার গ্রাহক হওয়া যেত। পত্রিকায় বিজয়ী প্রতিযোগীদের নাম ছাপা হত। তাদের মধ্যে একজনের নাম বেছে আমি সম্পাদককে চিঠি লিখেছিলাম:

মাননীয় সম্পাদক,

আমি অমুক, একজন বিজয়ী প্রতিযোগী। আমাদের ঠিকানা বদল হয়েছে। এখন থেকে আমার বিনামূল্যে প্রাপ্য সংখ্যা ডাকযোগে বক্সিরহাটে পাঠালে বাধিত হব।

বাড়ির নম্বর হল…

আমাদের সঠিক ঠিকানা না দিয়ে পাশের দোকানের ঠিকানা জানালাম যাতে করে পত্রিকা আব্বার হাতে না পড়ে। প্রতি মাসে আমরা সেই বিনামূল্যের সংখ্যার অপেক্ষায় বসে থাকতাম। এবং এই পরিকল্পনা নিখুঁতভাবে স্বপ্নের মতো কাজ করেছিল। "

গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বব্যাপি জনপ্রিয় হচ্ছে তাঁর নতুন ধারণা ‘থ্রি জিরো ওয়ার্ল্ড’। যেখানে তিনি ধারণা দিয়েছেন আগামী বিশ্ব সকলের নিরাপদ বসবাসের উপযোগী করে তুলতে দারিদ্র হতে হবে শূন্যের কোটায়, বেকারত্ব থাকতে হবে শূন্যের কোটায়, আর গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণও হতে হবে শূন্য। আর এই তিন শূন্য কিভাবে নিশ্চিত করা যায় তার ধারণা তিনি শেয়ার করেছেন তাঁর " অ্যা ওয়ার্ল্ড অব থ্রি জিরো'স " বইতে। ইতোমধ্যে তাঁর নতুন এই চিন্তাদর্শন কাজে লাগাতে শুরু করেছে বিশ্বের অনেক দেশ। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অর্গানাইজেশন তাঁর চিন্তার আদলে সাজাচ্ছেন তাদের সামাজিক বিজনেস কার্যক্রম। তাঁর এই চিন্তাদর্শন যত দ্রুতগতিতে বিস্তার করছে বিশ্বব্যাপি মানুষের মধ্যে। তাতে ধারণা করা যাচ্ছে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তিনি আবারও নতুন করে অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়ার জন্য আলোচনায় থাকবেন।

গত কয়েক দশকে প্রফেসর ইউনূস পৃথিবীর যে দেশেই গিয়েছেন সেখানেই সমাদৃত হয়েছেন, সমৃদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের নাম। পৃথিবীর যে প্রান্তে গেছেন সেখানেই মানুষ তাকে সর্বোচ্চ সম্মান জানিয়েছেন। এ মুহূর্তে জীবিত লিডিং ইন্টেলেকচুয়ালদের তালিকা করলে টপে থাকবে তাঁর নাম। সেরা পাঁচ ইন্টেলেকচুয়ালের মধ্যে একজন হবেন তিনি। ইউনূস এদেশের ছেলে, এ পরিচয় আমাদের জন্য পরম গর্ব এবং আনন্দের। বাংলাদেশি পোস্টারবয় হিসেবে বিশ্বে এদেশের একমাত্র গ্লোবাল আইকন কেউ হয়ে থাকলে তিনি হলেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। একশো বছরেও এমন একজন ইউনূস তৈরি করা সম্ভব নয়।

Next Post Previous Post
📢 আপনার ব্র্যান্ড/প্রতিষ্ঠানের কথা জানুক হাজারো অনলাইন পাঠক আজই বিজ্ঞাপন দিন 🛍️