যেভাবে বোনের চার সন্তানের 'মা' হয়ে উঠলেন হিবা

গাজায় ইসরাইলের গণহত্যামূলক আগ্রাসনে বদলে গেছে স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের জীবন। যা তারা আগে কল্পনা করতে পারতেন না, এখন তা-ই বাস্তব হয়ে তাদের সামনে ধরা দিয়েছে।

| হিবা আল-নামনাম নামের গাজার এই নারী প্রত্যাশা করেননি চার অনাথ শিশুর দায়িত্ব তাকে নিতে হবে

২০২৩ সালের অক্টোবরের আগে হিবা আল-নামনাম কল্পনা করতে পারেননি তাকে জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলে অস্থায়ী কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে হবে। ৩২ বছর বছর বয়সি গাজার এই নারী প্রত্যাশা করেননি চার অনাথ শিশুর দায়িত্ব তাকে নিতে হবে।

ইসরাইলি হামলার মুখে ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর উত্তর গাজার জাবালিয়ার বাসিন্দা হিবার বাবা-মা ও দুই ভাইবোন নিজ বাড়ি ছেড়ে চলে যান। কিন্তু হিবা বাড়ি ছাড়তে অস্বীকার করেন।

তবে বেশিদিন তাকে একা থাকতে হয়নি। কদিন পরই বাইত লাহিয়া থেকে পরিবারসহ তার বড় বোন আলা চলে আসেন। আলার সঙ্গে তার স্বামী রায়েদ ছাড়া আরো ছিল তাদের চার সন্তান- ১৪ বছর বয়সি ইবরাহিম, ১২ বছর বয়সি লানা, ১০ বছর বয়সি এলা ও ৮ বছর বয়সি ইলিয়াস।

তাদের উপস্থিতি হিবার মনে শক্তি ও আশা জাগায়। তিনি বলেন, ক্রমাগত ইসরাইলি বোমা হামলার মধ্যে একা থাকা ভয়াবহ। কিন্তু বেশিদিন তারাও বাড়িতে থাকতে পারেননি। ইসরাইলি হামলা ক্রমাগত বাড়ায় বোনের পরিবারসহ হিবা বাড়ির কাছাকাছি একটি স্কুলে আশ্রয় নেন, যেখানে আরো শত শত ফিলিস্তিনি পরিবার আগে থেকেই আশ্রয় নিয়েছে।

২০২৪ সালের ২৬ জানুয়ারি আলার স্বামী রায়েদ নিখোঁজ হন। হিবা জানান, রায়েদের ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তিনি কোথায় গেছেন, তার কোনো ধারণাই তাদের নেই। একটা মুহূর্তও বিমান হামলা বন্ধ হচ্ছিল না।

পরে রায়েদের খোঁজে আলা, হিবা ও তাদের বন্ধুরা সম্ভাব্য সব জায়গায় অনুসন্ধান করেন; কিন্তু তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। হিবা জানান, তার অনুপস্থিতিতে তাদের দুর্ভোগ আরো বেড়ে যায়।

২২ দিন পর ইসরাইলি বাহিনী সেনা প্রত্যাহার করলে বাইত লাহিয়ার বাড়ির কাছাকাছি রায়েদের পচে যাওয়া লাশ উদ্ধার করা হয়।

হিবা বলেন, 'আমার বোন আলা পরনের পোশাক ও জুতা দেখে তাকে শনাক্ত করেন। তারা রায়েদকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছে এবং তার স্ত্রী ও চার সন্তানকে যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে একা ফেলে দিয়েছে।'

শোকাহত বোন ও তার সন্তানদের পাশে থাকতেই হিবা তাদের সঙ্গে রয়ে যান। আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত স্কুলটিই তাদের একমাত্র বাসস্থানে পরিণত হয়েছে। ইসরাইলের আগ্রাসন বাড়তে থাকায় গাজায় মানবিক সংকটও তীব্র হয়ে উঠেছে। পুরো অঞ্চলেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে।

২০২৪ সালের ৬ অক্টোবর ইসরাইলি হামলার মধ্যেই আলা তার চার সন্তানসহ বাইত লাহিয়ায় নিজেদের বাড়িতে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাপড়-পোশাক নিয়ে আসছিলেন। কিন্তু ফেরার পথে এক ইসরাইলি হামলায় আলা নিহত হন এবং তার চার সন্তান আহত হন।

হিবা বলেন, 'আমি তাদের জন্য স্কুলে অপেক্ষা করছিলাম। আগে থেকেই আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম। যখন শুনলাম তাদের ওপর হামলা হয়েছে, তখন আমি কামাল আদওয়ান হাসপাতালে ছুটে যাই।'

তিনি বলেন, 'সাদা কাফনে মোড়ানো বোনকে দেখার মতো সাহস আমার হয়নি। এমনকি দাফন করার সময়ও আমি সেখানে থাকতে পারিনি।'

কিন্তু শোকের জন্য সময়ও ছিল না। আলার সন্তানদের জন্য তাকে ছাড়া আর কেউ ছিলেন না।

ওই হামলায় ইবরাহিমের ডান চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এলারও এক চোখ হারানোর ঝুঁকি ছিল, লানার পায়ে কিছুটা জখম হয় এবং ইলিয়ানের ডান পায়ে হালকা চোট লাগে।

কিন্তু বাবা-মা দুজনকেই হারিয়ে তারা একেবারে অসহায় হয়ে পড়ে। সেই থেকে বোনের ওই চার সন্তানের মা হয়ে ওঠেন হিবা।

তিনি বলেন, 'যেদিন আলা নিহত হয়, হাসপাতালে তার আহত সন্তানদের পাশে থেকে আমার উপলব্ধি হয়- শুধু এ কারণেই আল্লাহ আমাকে উত্তর গাজায় রেখে দিয়েছেন, যখন আমার পরিবার প্রাণ বাঁচাতে দক্ষিণে পালিয়ে গেছে।' হিবা ওই চার শিশুর খাওয়া-পরা, চিকিৎসার সব কাজ করে আসছেন। গত ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি শুরুর পর তারা নিজেদের ঘরে ফিরেছিলেন। কিন্তু তা পুরোপুরিই ধ্বংস হয়ে গেছে। পরে কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় আগের স্কুলেই ফিরে গেছেন তারা।

হিবা এখন অপেক্ষা করছেন যুদ্ধ শেষ হলেই গাজার বাইরে সফরের অনুমতি পাওয়ার। যাতে করে ইবরাহিম ও এলার যথাযথ চিকিৎসা করা যায়। হিবা বলেন, 'প্রতিদিন আমি ইবরাহিম, লানা, এলা ও ইলিয়াস থেকে শক্তি পাই। তারা আমাকে শিখিয়েছে, দায়িত্ববোধ আসলে কী।'

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url