তব তবি তব তব তবালি ভাইরাল এই আরবি নাশিদের পেছনে রয়েছে মজাদার এক ঐতিহাসিক গল্প
"তব তবি তব তব তবালি" বিখ্যাত আরবি নাশিদ যা সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক ভাইরাল হওয়া হয়েছে। গানটি ইন্টারনেটে পুরো জেঁকে বসেছে এবং সবার মধ্যেই এটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে।
![]() |
ভাইরাল এই আরবি নাশিদের পেছনে রয়েছে রোমাঞ্চকর এক ঐতিহাসিক গল্প |
তবে আপাতদৃষ্টিতে এই গানটি মনে হতে পারে যে খুব অর্থহীন এবং কোনো এক অলস মস্তিষ্ক থেকে বের হয়ে এসেছে এই গান, এর কোনো ঐতিহাসিক পটভূমিও নেই এমন মনে হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
প্রকৃতপক্ষে অর্থহীন মনে হওয়া এই গানের পিছনে রয়েছে বুদ্ধি ও প্রতিভার মিশেলে অবাক করা এক ঐতিহাসিক গল্প।
সাধারণত "তব তবি তব" নামে খ্যাত এই গানের আসল নাম সাওত সাফির আল-বুলবুল বা বাংলায় রূপান্তর করলে যার অর্থ দাড়ায় বুলবুলির কিচিরমিচির।
![]() |
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে সাধারণত গান হিসেবে ধরা হলেও এর উৎপত্তি হয়েছে কবিতা হিসেবেই। পৃথিবী জুড়ে গানটির খ্যাতি নতুন হলেও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায়শই এই গানটি গাওয়া হয় এবং ছোট ছোট বাচ্চাদের শিখানো হয় এটি।
কিন্তু কীভাবে উৎপত্তি হয়েছে এই কবিতার তা জানতে হলে যেতে হবে ১২০০ বছর পূর্বে আব্বাসীয় খেলাফতের যুগে। বাগদাদে তখন দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুরের রাজসভা চলছে।
খলিফা আল-মনসুর কবিতার প্রচন্ড ভক্ত ছিলেন এবং তার স্মৃতিশক্তি এতোই ভালো ছিলো যে তিনি যেকোনো কবিতা শুধুমাত্র একবার শুনেই মুখস্থ বলতে পারতেন।
আব্বাসীয় খলিফা আবু জাফর আল মানসুর অনেক মেধাবী আর চতুর খলিফা ছিলেন, তিনি কবিদের পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত করার জন্য এক প্রকার কৌশল অবলম্বন করতেন। তিনি এতটাই মেধাবী ছিলেন যে, যেকোনো কবিতা একবার শুনলেই তিনি মুখস্থ করে ফেলতেন। তার একজন গোলাম ছিল যে দুইবার শুনলে মুখস্থ করতে পারতো আর একজন দাসী ছিল যে তিনবার শুনলে মুখস্থ করতে পারতো।
তাই যখনই কোনো কবি তার কবিতা শুনাতে দরবারে আসতো, তখন তিনি (খলীফা) একবার শুনেই মুখস্থ করে ফেলতেন, এবং বলতেন: এই কবিতা তো আমি আগেও শুনেছি। এটা নতুন কোনো কবিতা নয়, নতুন হলে আমি কিভাবে একবার শুনেই মুখস্থ করলাম সুতরাং তুমি পুরষ্কার পাওয়ার যোগ্য নও। খলিফা এবং কবি দুইজন দুইবার আবৃত্তি করাতে তার গোলামটাও মুখস্থ করে ফেলে, এবং খলিফার দল ভারী হয়ে যায়। পরবর্তীতে গোলামও যখন আবৃত্তি করে তখন তিনবার শোনায় দাসীটাও মুখস্থ করে ফেলে। এবং বলে, আমিও তো শুনেছি এই কবিতা। এরপর আর কোনো কবিকেই তার নির্ধারিত পুরষ্কার দেয়া হয় না।
এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে কবিরা অনেক পরিশ্রম করে কবিতা লিখার পর তার সামনে এসে কবিতা আবৃত্তি করলে তিনি বলতেন যে, এই কবিতাটি তিনি আগেও শুনেছেন এবং এটা তার কণ্ঠস্থ।
যখন কবিরা জানাতো যে এটি তাদের মৌলিক কবিতা তখন তিনি কবিতাটি আবৃত্তি করে শুনাতেন এবং বলতেন যে তিনি তাহলে কীভাবে কবিতাটি বলতে পারলেন আগে থেকে না জানলে। এভাবে অনেক কবিই তার দরবার থেকে খালি হাতে ফিরে যেত।
তবে এক সময় কবি আল-আসমাইয়ী খলিফার এই চতুর কান্ডের কথা শুনতে পান এবং তিনি বুঝে ফেলেন খলিফার কৌশল। তিনি খলিফার দরবারে গিয়ে জানান যে, তিনি এমন একটি কবিতা লিখতে পারবেন, যেটা খলিফা আগে কখনও শুনেননি। খলিফা তাকে বলেন এমন কবিতা লিখতে পারলে যেই জিনিসের উপর লেখা হবে তার সমান ওজনের স্বর্ণমুদ্রা তাকে প্রদান করা হবে।
তখন কবি আল-আসমাইয়ী এই বিখ্যাত কবিতাটি লিখেন, যাকে তিনি বুলবুলির কিচির-মিচির নাম দেন ।
খুব অদ্ভুত বাক্য প্রণালী ও অর্থহীন শব্দ ব্যবহার করে কবিতাটি লিখা হয়।
পরের দিন কবি আল-আসমাইয়ী খলিফাকে কবিতাটি শুনালে প্রথমবারের মতন খলিফা একবার শুনে কবিতাটি বলতে পারেননি। তখন তিনি জিজ্ঞেস করেন কিসের উপর কবিতাটি লেখা হয়েছে সেই পাথরের খন্ডটি নিয়ে আসতে। কিন্তু তখন আল-আসমাইয়ী জানান যে তা তিনি একটি ভূপতিত পাথরের স্তম্ভে কবিতাটি লিখেছেন যা কাঁধে নিতে ছয়জন শক্তসমর্থ সৈনিকের প্রয়োজন।
খলিফা যখন বুঝতে পারলেন যে আল-আসমাইয়ী'কে এতো স্বর্ণ দিতে হলে তার কোষাগার খালি হয়ে যাবে। তখন আল-আসমাইয়ী বললেন যে, তার স্বর্ণের দরকার নেই কিন্তু যেসব কবিরা আগে খালি হাতে ফিরে গিয়েছে তাদের যেন তাদের প্রাপ্য স্বর্ণ বুঝিয়ে দেওয়া হয় এবং খলিফা যেন এভাবে আর কোনো কবিকে না ঠকান।
অন্যদিকে আরেকটি সূত্র থেকে জানা যায় যে, খলিফা প্রথম থেকেই জানিয়ে রাখতেন যে, এমন কবিতা লিখতে হবে যা তিনি মুখস্থ করতে পারবেন না একবার শুনেই এবং তা করতে পারলে যার উপর কবিতাটি লেখা হবে তার সমান ওজনের স্বর্ণ দেওয়া হবে কবিকে।
তখন আল-আসমাইয়ী তার এই বিখ্যাত কবিতাটি লিখেন।
যখন আল মনসুর কবিতাটি মুখস্ত করতে পারেননি তখন তিনি কবিতাটি কোথায় লেখা হয়েছে তা জানতে চান এবং যখন দেখেন যে কবিতাটি আল-আসমাইয়ের গাধার উপর লেখা হয়েছে তখন তিনি প্রচন্ড বিস্মিত হন।
কিন্তু তাও তিনি আল-আসমাইয়ের প্রতিভায় খুশি হন প্রথমবারের মতো এরকম কবিতা লিখতে পারার জন্য। তিনি আল-আসমাইকে তার গাধার ওজনের সমাণ স্বর্ণ প্রদান করেন।
তবে দিনশেষে মনে রাখা উচিৎ এই ইতিহাসগুলো লোকমুখে চলে আসা লোকগাথা এবং এর কোনো লিখিত রূপ নেই। তাই শুনতে অন্তত চমকপ্রদ মনে হলেও চোখ বুঁজে বিশ্বাস না করে নেয়াই উত্তম।