নরখাদকের ডায়েরী: নৃশংস পাশবিক ঘটনার স্বাক্ষী
নরখাদকের ডায়েরি: নৃশংস পাশবিক ঘটনার স্বাক্ষী
বইটির নাম শুনেই বুঝেছিলাম বইটি অন্য বই থেকে একেবারেই ভিন্ন ধরণের। বইটি জুড়ে সমাজের অন্তরালে ঘটে যাওয়া নৃশংস পাশবিক ঘটনার বর্ণনা। ঠান্ডা মাথায় ১৫ বছর ধরে ৪৯ জন মানুষের মাংস ভক্ষণ করা কার্ল ডেনকের বীভৎসতা পাঠকের মনে ভয়ের ও ঘৃণার উদ্বেগ ঘটাবে।
![]() |
কার্ল ডেনকে বইটি পাওয়া যাচ্ছে অ্যামাজন ডটকমে |
কার্ল ডেনকে (নরখাদক ও ধারাবাহিক খুনি) বইটির শুরুতেই তার ছোটবেলার ইতিহাস বর্ণনা করেছে- পরিবার ও স্কুলে তাকে প্রায় প্রতিদিনই শাস্তি পেতে হতো। ছোটখাটো কাজ না পারার জন্য বাড়িতে তাকে শাস্তি পেতে হতো আর স্কুলে পেতে হতো লেখাপড়া না পারার জন্য।
নির্মম অত্যাচার সহ্য করা ডেনকে তার আত্মজীবনীতে বলেন- 'আমি যা পারি না সেটা আমাকে শাস্তি দিলেও পারব না।'
এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ একটি বার্তা দেয়; শিশুদের সাথে কখনোই নির্দয় আচরণ করা ঠিক না, এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিই বেশি হয়। তারচেয়ে বরং বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাদেরকে দিয়ে অনেক অসাধ্য কাজ সাধন করানো যায়।
ডেনকের পারিবারিক বন্ধন ভালো ছিলো না। ছোটবেলা থেকেই তার বাবা-মা, ভাই-বোন কেউই তাকে গুরুত্ব দেয়নি। ডেনকে স্বাধীনভাবে বাঁচার চেষ্টায় বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় এবং মি. মার্ফি নামের এক ব্যক্তির কাছে আশ্রয় পায়। মি. মার্ফি বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত মানুষের চামড়া, হাড়, মাংশ, দেহাবশেষ এসব সংগ্রহ করে।
যা পরবর্তীতে ডেনকেকে ভিক্টিমদের চামড়া, হাড়সহ শরীরের নানান অংশ সংগ্রহ করতে উৎসহ প্রদান করে।
ছোটবেলা থেকে ডেনকের খাবারের প্রতি আকর্ষণ বেশি ছিলো, বিশেষ করে মাংসের প্রতি। পরিবারের অন্যরা যখন তার বেশি খাবার খাওয়া নিয়ে ব্যঙ্গ করতো তখন ডেনকে ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। অন্তর্মুখী ডেনকে কাউকে কিছু না বলে সমস্ত রাগ নিজের উপর দেখাতো।
স্কুলে খেলাধুলায় হেরে গিয়ে নিজের বাহু কামড়ে মাংস খেয়ে রাগ মিটায় সে। ডেনকের ভাষায়- "আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারি না যে কিভাবে আমার বাম বাহুর একদলা গোশত ছিঁড়ে আসে আমার মুখে, আর আমি তা চিবিয়ে খেয়েও ফেলি যখন খেয়াল হলো তখন আমার বাহু থেকে রক্ত ঝরছে।"
নিজের গোশতই প্রথম তাকে নরমাংসের স্বাদ এনে দেয়।
বাড়ি থেকে পালানো ডেনকে যখন বাড়ি ফিরে আসে তখন পরিবারের সদস্যরা তাকে দেখে খুশি হয় না। এমনকি দুর্ভিক্ষের সময় ডেনকে তার পরিবারের কাছে গেলে তারা ডেনকের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করে যার ফলে ডেনকে পরিবার থেকে পুরোপুরি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং জীবনে আর কখনো তাদের সাথে যোগাযোগ করে না।
যদি পরিবার ডেনকেকে আশ্রয় দিত তাহলে হয়ত সে এমন পাপ কাজে লিপ্ত হতে পারতো না। ইতিহাস স্বাক্ষী, পরিবার একটি মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। আপনজনরাই পারে মানুষকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে।
বইটিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া মারাত্নক দুর্ভিক্ষের তথ্য রয়েছে এবং সে সময় মানুষ হয়ে মানুষের গোশত খাওয়ার ভয়ংকর বর্ণনাও রয়েছে, যেমন- ১৮৪৫ থেকে ১৮৫২, এই সাত বছর আয়ারল্যান্ড মহাদুর্ভিক্ষের শিকার হয়। প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়।
'জন কনোলী' নামের এক ব্যক্তি অনাহারে মৃত ছেলেকে কফেনে না শুইয়ে তার গোশত খেয়ে নিজের প্রাণ বাঁচায়।
১৩১৫ সালে উত্তর ইউরোপে দুর্ভিক্ষ ছড়াতে শুরু করে। ক্ষুধার জ্বালায় বাবা- মা সন্তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। জেলের বন্দিরা তাদের সঙ্গীদের ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছে।
বইটিতে জাদুচর্চা ও জাদুকরদের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। যেমন- জার্মানির ট্রায়ানে ১৫৮৩-৯৪ পর্যন্ত চলে ডাইনি বা জাদুকর নিধন। আনুমানিক ৩৬৮ জন মানুষকে মারা হয়েছিল সে সময়।
সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি স্কটল্যান্ডে শুরু হয়েছিল জাদুবিদ্যার সাথে জড়িতদের ধরপাকড়। এবং ৪৫০ জনকে মৃত্যুদন্ডও দেওয়া হয়েছিল।
![]() |
কার্ল ডেনকে Karl Denke; জার্মান সিরিয়াল কিলার |
ডেনকে সমাজের চোখে ভালো মানুষ সেজে থাকে। এলাকার লোক তাকে 'ফাদার ডেনকে' বলে ডাকে। ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে ডেনকে একের পর এক মানুষ হত্যা করে নিজের লালসা পূরণ করে। আমাদের সমাজেও এমন মুখোশধারী ভালো মানুষের অভাব নেই, যাদের নারকীয় উল্লাসের শিকার হয়ে প্রতিনিয়ত জীবন দিচ্ছে দুর্ভাগা মানুষগুলো।
ডেনকে সব সময় স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম অথবা অন্য এলাকা থেকে আগত সাময়িক অসুবিধার মুখোমুখি মানুষদেরকে নিজের মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে বাড়িতে এনে শিকার করে।
সুতরাং এ ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয় অপরিচিত অথবা অল্পপরিচিত কারো কথায় বিশ্বাস করে নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া যাবে না।
ডেনকে একসময় ভবিষ্যৎ জানার চেষ্টা করে এবং এবিষয়ে পড়াশোনা করে।
চাঁদ এবং নদীগুলির উপর চাঁদের প্রভাব এবং একটি সাম্প্রদায়িক ক্যালেন্ডার সংগঠনের বিষয়গুলো রেকর্ড করার প্রথম পদক্ষেপ ছিল।
ব্যাবিলন ও কালদিয়া অঞ্চলে এ বিদ্যা ব্যাপকভাবে শুরু হয় এবং সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।
ইউরোপে প্রকাশিত প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞান গ্রন্থটি ছিল "লাইবার প্লানেটিস এন্ড মুন্সি ক্লাইমাটিবাস।"
ভবিষ্যৎ দেখার জন্য যুগে যুগে নানা কৌশল ব্যবহার করা হয়,যেমন- হস্তরেখা দেখা, ক্রিস্টাল বল ব্যবহার, ধাতব পেয়ালা, রুপার পেয়ালা ব্যবহার করা ইত্যাদি।
তিব্বতীয় সাধকরা ক্রিস্টাল বল ব্যবহার করতেন।
ব্যাবিলনে উজ্জ্বল ধাতব ব্যবহার করা হতে।
ডেনকে নিজেও ক্রিস্টাল বল ব্যবহার করে ভবিষ্যৎ জানার চেষ্টা করে এবং এক পর্যায়ে সে সফলও হয়। ডেনকে পরবর্তী একসময় নিজের শেষ পরিনতি ক্রিস্টাল বল ব্যবহার করে দেখে নেয়। সে জানতো তার শেষ পরিনতি পুলিশের হাতে ধরা পড়া এবং সবার ঘৃণা ও অভিশাপ নিয়ে করুণ মৃত্যু বরণ করা। সুতরাং ডেনকে সকলের ঘৃণা ভরা চোখ দেখার আগেই আত্মহত্যা করে।
প্রাচীন ইউরোপে শাস্তির খুব নিকৃষ্ট ধরণ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় নরখাদকের ডায়েরি বইটিতে।
সর্বপ্রথম প্রাচীন গ্রীসে একটা পদ্ধতি চালু হয়। যার নাম র্যাগ। এ পদ্ধতিতে প্রচন্ড যন্ত্রণা দিয়ে কপিকলের মাধ্যমে অপরাধীকে মারা হতো।
প্রাচীন ইউরোপে ভিক্টিমের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চামড়া ছিলে নেওয়া হতো, এতে রক্তক্ষরণে অপরাধীর মৃত্যু হতো।
প্রাচীন চীনে লিং পদ্ধতিতে জল্লাদ ছুরি দিয়ে বুকের বামপাশ কেটে নিত তারপর বিরতি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাংস কেটে নিত ফলে রক্তক্ষরণে অপরাধীর মৃত্যু হতো।
গ্রিসে পিতলের তৈরি ষাঁড়ের ফাঁকা পেটের ভেতর আসামি ঢুকিয়ে নিচে আগুন জ্বেলে দেয়া হতো। আসামি আগুনের প্রচন্ড তাপে সিদ্ধ হয়ে মারা যেত।
ডেনকে তার ভিকটিমদের চামড়া দিয়ে বই/ ডায়েরির মলাট, জুতার ফিতা, সাসপেন্ডার, মানিব্যাগ,জ্যাকেট তৈরি করতো। দাঁতগুলো দিয়ে বোতাম, আংটি, লকেট তৈরি করতো।
চুলগুলো দিয়ে রশি তৈরি করতো। ডেনকের মৃত্যুর পর পুলিশ তার ঘর তল্লাশি করে এসব পায়।
ডেনকের মানুষ মারা এবং কেটেকুটে খাওয়ার অংশটা প্রচন্ড বিভৎস, তাই এসম্পর্কে কিছু লিখতে চাই না। পড়তে গিয়ে গা গুলিয়ে উঠেছে।
দুর্বল চিত্তের পাঠকদের অনুরোধ করবো বইটি এড়িয়ে যেতে।
নরখাদকের ডায়েরি বইটিতে আধিভৌতিক কিছু ঘটনার বর্ণনা আছে। ডেনকের মতো হৃদয়হীন নিষ্ঠুর মানুষের মনেও ভৌতিক ঘটনাগুলো ভয়ের সঞ্চয় করেছে। ডেনকের ভাষায়-' অদৃশ্য কেউ একজন আমার হাত ধরে বসল! আর আমার হাত থেকে (মাংস) তা নিয়েও নিল।
তারপর সেই লবণাক্ত টুকরো শূন্যে ভাসতে লাগলো।"
নরখাদক ডেনকে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় কারণ সে সমাজের ঘৃণিত দৃষ্টি ভয় পেয়েছিল। সবাই তার জঘন্য অপরাধ জানার পর কি হবে সে তা অনুমান করতে পারে এবং আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়।
ডেনকের ভাষায়- ' হাকিম সাহেব ভয়ানক কোন মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেবে।
আমি আর ভাবতে পারছি না। আমি এমন সময়ের মুখোমুখি হতে পারবো না। তার আগেই আমার মরে যাওয়া ভালো। "
উপন্যাসটি সবাইকে এই বার্তা দেয় যে, অত্যাচারির পরিণতি কখনো ভালো হয় না। অন্যায় করলে একদিন তার শাস্তি পেতেই হবে।
লেখনির শুরুতে বলেছিলাম 'নরখাদকের ডায়েরি' বইটি হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখেছি বেশ কিছুক্ষণ কারণ বইটির বাঁধাই, ছাপাসহ বিন্যাস আমাকে মুগ্ধ করেছে। এজন্য বিশেষ ধন্যবাদ জানাতে চাই 'অক্ষরবৃত্ত প্রকাশনকে'। বইটি পড়তে গিয়ে যেমন লেখক সম্পর্কে উন্নত ধারণা হয়েছে তেমনি প্রকাশনীর উপর আস্থা বেড়েছে।
সর্বশেষ বলবো, 'নরখাদকের ডায়েরি' 'আহমাদ স্বাধীনের' এক উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। প্রিয় লেখকের এমন তথ্য ভিত্তিক বই আরও পড়তে চাই।
দেড়শো বছর আগের এক নরখাদকের ব্যক্তিগত রচনার সাথে লেখকের কল্পনার মিশ্রণ, হরর প্রিয় পাঠকদের কাছে উপন্যাসের নতুন স্বাদ এনে দেবে বলে আমার বিশ্বাস।
নৃশংস পাশবিক ঘটনার স্বাক্ষী : নরখাদকের ডায়েরি
বই : নরখাদকের ডায়েরি
লেখক: আহমাদ স্বাধীন
প্রচ্ছদ: হিমেল হক।
প্রকাশনী: অক্ষরবৃত্ত
মূল্য: ২০০ টাকা